আসবে না তো যাবে কোথায়?
মীরপুরে ওর খালার বাড়ি। মনে হচ্ছে, ওখানেই থেকে যাবে। মাঝে-মাঝে রাত বেশি হলে থেকে যায়।
খবর দেয় না?
কীভাবে দেবে, ও বাড়িতে কি টেলিফোন আছে?
আপনার চিন্তা হচ্ছে না?
ভদ্রলোক এমনভাবে তাকালেন যেন আমার বেয়াদবিতে স্তম্ভিত হয়েছেন। তিনি কী বলবেন মনে-মনে তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। খুব রেগে গেলে মানুষ মজার-মজার সব কথা বলে। অবশ্যি ভদ্রলোক মজার কিছু বললেন না। বড় রকমের একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বাড়ি চলে যাও, নয়ত বাস পাবে না। লাস্ট বাস সাড়ে এগারটায়।
বাস সত্যি-সত্যি পেলাম না। তিন মাইলের মতো হেঁটে একটা রিকশা জোগাড় করতে হল। রিকশায় ওঠামাত্র রিকশাওয়ালা যে কথা বলল, তার সারমর্ম হচ্ছেকলেজ গার্ল লাগবে কি না। তার সন্ধানে প্রচুর কলেজ গার্ল আছে। ভালো ফ্যামিলির মেয়ে। অভাবে পড়ে এই লাইনে এসেছে।
আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। রিকশাওয়ালা আমার জন্যে কলেজ গার্ল জোগাড় করে ফেলেছে এই জন্যে নয়। এরা একটা চক্রের সঙ্গে আছে। এদের হাতে যেমন কলেজ গার্ল আছে, তেমনি গুণ্ডাপাণ্ডাও আছে। পেটে ছুরি বসিয়ে আমাকে নর্দমায় ফেলে দেওয়া এদের কাছে ছেলেখেলা। আমি রিকশাওয়ালাকে খুশি রাখবার জন্যেই সরাসরি না বললাম না। বললাম, খরচপাতি কীরকম লাগবে?
রেইট হইল গিয়া আফনের ঘন্টা হিসাবে। পঞ্চাশ আছে, যাইট আছে, আবার ধরেন গিয়া এক শ আছে। যেমুন জিনিস তেমুন দাম।
আরে সর্বনাশ, আমার কাছে আছেই মাত্র দশ টাকা। আরেক দিন আসা যাবে।
বাস স্ট্যান্ডের বগলে দোকানে আমার নাম কইয়েন, তাইলে খবর পাইবেন।
কি নাম তোমার?
বদিউল।
ঠিক আছে বদিউল, তোমাকে খুঁজে বের করব। দুএকদিনের মধ্যেই আসব। তবে খরচপাতি অনেক বেশি।
সেইটা আমি দেখমু। খরচপাতির জইন্যে চিন্তা করবেন না।
আমি প্রতিজ্ঞা করলাম যাত্রাবাড়ির দিকে আর আসছি না।
বদিউল নামের রিকশাওয়ালা আমাকে চিনে ফেলতে পারে। চিনে ফেললে হয়তো চেপে ধরবে। ঘন্টা হিসেবে এক জন কলেজ গার্ল জুটিয়ে দেবে। সেই কলেজ গার্ল নিয়ে আমি করব কী? যাব কোথায়? ঢাকা শহর গিজগিজ করছে মানুষে। একটা গর্ত খুড়লে সেই গর্ত দেখার জন্যে হাজার-হাজার মানুষ জমে যায়। একটা মাইক ফিট করে হ্যালো ওয়ান টু থ্রি বললে চার-পাঁচ হাজার লোক দাঁড়িয়ে যায়। এখানে নিরিবিলি কোথায় যে কলেজ গার্লের সঙ্গে দুএকটা মিষ্টি কথা বলব? এশার সঙ্গে তিন বছর ধরে আমার পরিচয়, এখনো একটু নিরিবিলি পাই নি যে, হাত ধরে গাঢ়স্বরে দুএকটা কথা বলব কিংবা ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে যাব। ভালবাসার মেয়েকে চুমু খেতে কেমন লাগে কে জানে?
রিকশা যাত্রাবাড়ি পর্যন্ত যাবে না
আমার এই রিকশা নিশ্চয়ই যাত্রাবাড়ি পর্যন্ত যাবে না। তবু একবার জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। আমি বললাম, এই, যাত্রাবাড়ি যাবে?
না।
না কেন? যাত্রাবাড়িতে অসুবিধা কি?
যামু না—যামু না। ব্যাস ফুরাইল।
এত সহজে ফুরালে তো হবে না। কেন তুমি যাবে না সেটা বল।
রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে আমার দিকে তাকাল। লোকটা বয়সে সম্ভবত আমার বাবার কাছাকাছি। তাকাচ্ছেও আমার বাবার মতো করে, যেন আমার আচরণে মৰ্মাহত। আমাকে নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। রাগে যে সে কাঁপছে তা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। এক জন মানুষকে রাগিয়ে-রাগিয়ে ব্ৰেকিং পয়েন্টে নিয়ে যাওয়ার একটা আলাদা মজা আছে। আমি অনেকটা সময় নিয়ে সিগারেট ধরালাম। কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়লাম এবং বরফ-শীতল গলায় বললাম, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন? বল, তুমি কেন যাবে না?
রিকশা বদলির টাইম হইছে।
ও, এই ব্যাপার। আমি ভাবলাম আমাকে বোধহয় তোমার পছন্দ হচ্ছে না, এই জন্যে যেতে চাচ্ছ না। আচ্ছা এখন বল রিকশা বদলির কথাটা তুমি আগে কেন বললে না।
কি কইলেন?
রিকশা বদলির টাইম হয়েছে এই কথাটা তুমি আগে কেন বললে না। আগে বলতে কি অসুবিধা ছিল?
এমুন করতাছেন ক্যান ভাইজান? আমি আপনেরে কী করছি?
লোকটির গলা শুনে মনে হল সে এক্ষনি কেটে ফেলবে। এই শ্রেণীর লোকরা ব্ৰেকিং পয়েন্টে এসে রুখে দাঁড়ায়। এর বেলায় অন্যরকম হচ্ছে। এ কেঁদে ফেলতে যাচ্ছে। শহরের খাঁটি রিকশাওয়ালা সে এখনো হয়ে ওঠে নি। হয়তো কিছুদিন আগেও পান্তাভাত খেয়ে সূর্য ওঠার আগে জমি চাষ করতে যেত। এর গায়ে এখনো শস্যের গন্ধ লেগে আছে। আমি রিকশা থেকে নেমে পকেটে হাত দিলাম। তাপ্পি মারা নোট, না তাকে আমি চকচকে নোটই দেব। যা ন্যায্য ভাড়া, তার সঙ্গে বকশিশ হিসেবে দুটি টাকা ধরে দেব।
রিকশাওয়ালা ভাড়া নিল না। পকেট থেকে হাত বের করবার আগেই সে দ্রুত প্যাডেল চাপতে শুরু করল। একবার পিছনে ফিরল না। এ্যাই এ্যাই করে দু বার তাকে আমি ডাকলাম। সে আমাকে পুরোপরি উপেক্ষা করে বিপজ্জনকভাবে একটা বেবি ট্যাক্সিকে ওভারটেক করল। এই রিকশাওয়ালাটা অভিমানী। কে জানে। হয়তো ইতিমধ্যে তার চোখে পানি এসে গেছে।
এই রিকশাওয়ালার সঙ্গে নিশ্চয়ই আরো অনেকবার আমার দেখা হবে কিন্তু তাকে চিনতে পারব না। আমরা রিকশাওয়ালার চেহারা কখনো ভালো করে দেখি না। তাদের পেছনটাই দেখি।
এক জন রিকশাওয়ালা ভাড়া না নিয়ে চলে গিয়েছে এটা এমন কোন বড় ব্যাপার নয়। অনেক রিকশাওয়ালা আমাকে ঠকিয়েছে। ভাংতি হিসেবে অচল নোট দিয়েছে। জোর করে বেশি আদায় করেছে। এক জন তো দল পাকিয়ে আমাকে মারতে পর্যন্ত এসেছিল। সেইভাবে হিসেব করলে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। কিন্তু হচ্ছে না।