লক্ষ করছি, বাবা অপ্রস্তুত বোধ করতে শুরু করেছেন। মুখ কেমন লম্বা ধরনের হয়ে যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে বোকাটে। তিনি নিচু গলায় বললেন, কিসের ইন্টারভ্য?
বেক্সিমকো বলে একটা কোম্পানি।
তোর তো এমএ-র রেজাল্টই এখনো হয় নি!
রেজাল্টের আশায় বসে থাকলে আরো তিন বছর লাগবে। এখনো ভাই হয় নি। ভাইভা হবে, তারপর টিচাররা দয়া করে খাতা দেখবেন, আবার এক মাস ঘুম। তারপর চলে যাবেন বিদেশ। আর তাঁর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যাবে না। আমাদের রেজাল্টও বন্ধ।
বাবা তাঁর মুখ করুণ করে ফেললেন। বেচারাকে দেখে এখন মায়াই লাগছে। পুত্রের প্রতি সহানুভূতিতে তাঁর হৃদয় আর্দ্র।
ইউরিন স্যাম্পলটা কোথায় রেখেছেন বাবা? বাথরুমের তাকে?
থাক থাক। তোকে নিতে হবে না।
কোনো অসুবিধা নেই।
আহা, বললাম তো নিতে হবে না! যাচ্ছিস একটা শুভ কাজে।
আমি প্রায় জোর করেই ইউরিন স্যাম্পল নিয়ে নিলাম। অপরাধবোধে বাবা এখন জর্জরিত। সারাক্ষণ অস্বস্তিতে ভুগবেন। দুপুর বেলা ভালো করে খেতেও পারবেন না। অথচ আর একটু হলেই উল্টো ব্যাপার ঘটত। আমি যদি বোতলটা না নিয়ে আসতাম, তাহলে অপরাধবোধ আমাকে কাবু করে ফেলত। বারবার মনে হত, বুড়ো বাবার সামান্য একটা কাজ।
ঘর থেকে পা ফেলবার ঠিক আগমুহূর্তে মা বললেন, ধীরেন বাবুর কাছ থেকে পুরোনো ঘিটা দিয়ে যাস তো বাবা।
এক্ষুনি লাগবে?
হুঁ। বুক ঘড়ঘড় করছে। মালিশ করে দেব।
আমি তো তেমন কোনো ঘড়ঘড় শুনতে পেলাম না।
যা বাবা নিয়ে আয়, কতক্ষণ আর লাগবে?
মার চোখ এখন দেখাচ্ছে অবিকল গরুর মতো। ছলছল করছে, যেন এক্ষুনি পানি উপচে পড়বে। চোখের এই আবেগ অগ্রাহ্য করা অত্যন্ত কঠিন। তবে ইদানীং অনেক কঠিন কাজ বেশ সহজ ভঙ্গিতে করতে পারছি। আমি মার দিকে না তাকিয়ে বললাম, বিকেলে ফেরার পথে নিয়ে আসব। তুমি কোনো চিন্তা করবে না। বাবার কামান দাগা সন্ধ্যার আগে শুরু হবে বলে মনে হচ্ছে না।
মা আমার সঙ্গে-সঙ্গে আসছেন। তার মানে মার পেটে আরো কিছু কথা রয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরুবার পর তিনি তা উগরে দেবেন। কী বলবেন তাও আঁচ করতে পারছি। নাখালপাড়া যেতে বলবেন। আজ মাসের চব্বিশ। এই সময়ে আমাকে নাখালপাড়া যেতে হয়। আমার বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি। তার কাছ থেকে কিছু। টাকাপয়সা আনতে হয়। পরের মাসের তিন-চার তারিখে আমাকেই সেটা ফেরত নিয়ে যেতে হয়। গত মাসে টাকা ফেরত দেওয়া হয় নি, আবার এ মাসে যাওয়া!
বাবা বীরু।
বলে ফেল।
অনুর কাছে আজ একবার যেতেই হবে। তিন শ টাকা নিয়ে আসবি। বাবা, মানিক।
পাগল হয়েছ মা! আগামী এক সপ্তাহ নাখালপাড়ার দিকে যেতে পারব না।
একটা পয়সা ঘরে নেই।
বাবাকে বল–বাবার দায়িত্ব। সংসার চালানোর দায়িত্ব তোমাকে মাথায় নিতে কে বলেছে?
মাকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি রাস্তায় নেমে পড়লাম। চমৎকার একটা দিন। ঝকঝকে রোদ। বাতাস মধুর এবং শীতল। এই বাতাস আজ সারাদিনেও হয়তো তেতে উঠবে না। তবে একে না পাওয়া গেলে ভিন্ন কথা। তখন সবই অসহ্য বোধ হবে।
এই বীরু, যাচ্ছিস কোথায়?
আমি কয়েক মিনিট চিন্তা করলাম, জবাব দেব কী দেব না। টুকু নৰ্দমার পাশে পেচ্ছাব করতে দাঁড়িয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে সেখান থেকেই কথা বলছে। তার ছোটখাটো মুখে বিশাল এক গোঁফ। কুৎসিত দেখাচ্ছে।
ব্যাপার কী, সাউন্ড দিচ্ছি না কেন? যাচ্ছিস কোথায়?
ঠিক নেই কিছু।
তোর কাছে দশটা টাকা হবে নাকি?
না।
পাঁচটা হবে কি না দেখু। শালা পকেট একেবারে ইয়ে।
হবে না।
তাহলে একটা সিগারেট খাওয়া দোস্ত। রিকোয়েস্ট।
আমি দুটো সিগারেট কিনলাম। সিগারেট দিয়ে যদি সহজে তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এই আশাতেই কেনা। টুকু ছোঁ মেরে সিগারেট নিয়ে হাসিমুখে বলল,
একটা চায়ের পয়সা দিয়ে যা দোস্ত। তোর পায়ে ধরি।
টুকু সত্যি-সত্যি পা ধরতে এল। গুণ্ডামি করলেও টুকু জাতে ওঠে নি। কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। বিনা পয়সায় চা-সিগারেট খাওয়ায় না। নগদ পয়সা দিতে হয়।
দোস্ত, আমার রিকোয়েস্টটা রাখ। একটা পাত্তি ছেড়ে দে।
তুই অতসীদিকে কী বলেছিলি?
টুকু দপ করে নিভে গেল। মুখ আমশি করে বলল, মিসটেক হয়ে গেছে, বুঝতে পারি নি। আমি ভাবলাম নতুন কেউ। এমন লজ্জা পেয়েছি! আর বলিস না। রাতে ঘুম হয় নি।
অতসীদি তোকে যেতে বলেছে।
সত্যি?
হুঁ।
যাব কী করে, বল?
হেঁটে হেঁটে যাবি। আর কীভাবে যাবি? তোর জন্যে পালকি লাগবে?
অতসীদি আর কী বলল?
উনি আর কিছু বলেন নি–আমি বললাম।
কী বললি?
বললাম, তুই ঠিক করে রেখেছিলি বড় হয়ে অতসীদিকে বিয়ে করবি।
টুকু ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে তাকে।
আর কী বললি?
জিজ্ঞেস করল, তুই আজকাল কী করি। আমি বললাম, ছিনতাইয়ের কাজ। করে। পার্ট-টাইম কাজ। ফুল-টাইম কাজ হচ্ছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা, পরিচিত। কাউকে পেলে ভিক্ষা চাওয়া।
ব্লাফ দিচ্ছিস, ঠিক না?
ব্লাফ দেব কেন, ব্লাফ দেবার আমার দরকারটা কি? হাত ছাড়, আমার জরুরি। কাজ আছে।
টুকু আমার হাত ছাড়ল না সঙ্গে-সঙ্গে আসতে থাকল। তার গা থেকে বিকট গন্ধ আসছে। আমি বললাম, আজকাল গাঁজা খাচ্ছিস নাকি? গন্ধে নাড়িভূড়ি উলটে আসছে।
টুকু বিড়বিড় করে বলল, কী যে বলিস দোস্ত। ভদ্রলোকের ছেলে না আমি। সস্তার সিগারেট, এই জন্যেই গায়ে গন্ধ হয়ে গেছে। আচ্ছা দোস্ত, সত্যি কথাটা ব, অতসীদি কি যেতে বলেছে?