ভাগ্যিস দ্বিতীয় বার তার এই শখ হয় নি। নৌকার খাবার খেয়ে আমার নিজের পেট নেমে গেল। ডায়ারিয়ার মতো হল।
আজ এশার কী পরিকল্পনা, কে জানে। আজই সোমবার। ভাগ্যিস চিঠিটা খুলেছিলাম। চিঠি পড়ার ব্যাপারে আমার আগ্রহ একটু কম। একবার একটা চিঠি এক সপ্তাহ পর খুলেছিলাম। খামের উপরের লেখাটা পছন্দ ছিল না বলে ভোলা হয় নি।
দশটা বাজতে এখনো অনেক দেরি তবু আমার মনে হল, প্রস্তুতি পর্ব শুরু করে দেওয়া দরকার। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে একটির পর একটি ঝামেলা লাগে। আজ বিশেষ দিন। ঝামেলা লাগবেই। দাড়ি কমাতে গিয়ে দেখব ব্লেডে ধার নেই। শার্ট গায়ে দেবার পর দেখা যাবে পেটের কাছের বোতাম নেই। সমস্ত বাড়ি খুঁজেও রুমাল পাওয়া যাবে না। কিংবা এর চেয়েও ভয়াবহ কিছু ঘটবে মার কলিক পেন উঠবে এবং তাঁকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতেই মার কলিক পেন ওঠে। বাঁধা নিয়ম।
অনার্স সেকেন্ড পেপারের দিন এই অবস্থা। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে চোখ-টোখ উল্টে মা এমন এক নাটক শুরু করলেন, পরীক্ষা মাথায় উঠল। বাবা চি-চি করে বলতে লাগলেন, হাঁ করে দেখছিস কি? তোর মাকে হাসপাতালে নিয়ে যা।
আমি বিড়বিড় করে বললাম, আমার পরীক্ষা।
বাবা চোখ লাল করে বললেন, চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব হারামজাদা। মানুষ মারা যাচ্ছে, আর বলে কী!!
প্রয়োজনের সময় কিছুই পাওয়া যায় না। একটা বেবি ট্যাক্সি জোগাড় করতে লাগল আধঘন্টা। সেই বেবি ট্যাক্সিও এমন যে, দুমিনিট পরপর স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। ড্রাইভারকে কার্বুরেটার খুলে ময়লা পরিষ্কার করতে হয়। মেডিক্যাল কলেজের গেটে এসে মার কলিক পেন কমে গেল। তিনি বোকার মত হাসতে লাগলেন।
আজও নিশ্চয়ই এরকম কিছু হবে। ঘর থেকে পা বাইরে ফেলবার সময় মা চিকন গলায় ডাকবেন, ওরে বীরু রে! গেলাম রে।
আর আমার স্ত্রী-ভক্ত বাবা ব্যস্ত হয়ে উঠবেন তাঁর প্রিয়তমা পত্নীকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্যে। তিনি নিজে কিন্তু যাবেন না। এর আগের বারও যান নি। হাসপাতালের ফিনাইলের গন্ধ তাঁর সহ্য হয় না। ডাক্তারদের দুর্ব্যবহার সহ্য হয় না। টেনশান সহ্য হয় না। কিছুই সহ্য হয় না।
ইদানীং হয়তো জীবনটাও অসহনীয় হয়েছে। সকাল এবং সন্ধ্যায় প্রবলবেগে খকখক করে তাই জানান দিচ্ছেন। আমি গুনগুন করে বললাম, আমরা কাশির শব্দে ঘুমিয়ে পড়ি, কাশির শব্দে জাগি। পারুল আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে কঠিন চোখে তাকাল। আগেকার আমলের মুনি-ঋষিরা হয়তো ঠিক এরকম চোখের দৃষ্টি দিয়ে মানুষকে ভস্ম করে দিতেন।
আশ্চর্য কাণ্ড, দাড়ি কাটার পর্ব বিনা ঝামেলায় পার হল! থুতনির কাছের ভয়াবহ ব্ৰনটাকে আহত না-করে চমৎকার একটা শেষ করে ফেললাম। ইস্ত্রি করা একটা চেক শার্ট পাওয়া গেল যার সব কটি বোম অক্ষত। তোষক উল্টে একটা রুমাল পাওয়া গেল। মোটামুটি পরিষ্কার। ভদ্রসমাজে বের করলে কেউ সরু চোখে তাকাবে না।
মার কলিক পেন এখনো শুরু হয় নি। তিনি একতলার বারান্দায় চালের গুড়ো নিয়ে বসেছেন। মনে হচ্ছে ভাপা পিঠা হবে। কদিন আগে বাবা ভাপা পিঠার কথা কী যেন বলেছিলেন। এটা হচ্ছে তারই ফলোআপ। আমরা ভাপা পিঠা, ভাপা পিঠা বলে লক্ষবার চেঁচালেও কিছু হবে না, কিন্তু বাবা মুখ দিয়ে একবার উচ্চারণ করলেই অন্য ব্যাপার। টনা-টুনীর গল্প আর কি। টুনা কহিল টুনী পিঠা তৈরি কর…।
আমি দোতলা থেকে খুব সাবধানে পা ফেলে নিচে নামলাম। সিঁড়িতে কে যেন দুধ ফেলে দিয়েছে, যে-কোনো মুহূর্তে রেলগাড়ি ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম হবার সম্ভাবনা।
বাবা বারান্দায়। গলায় মাফলার। কোলে খবরের কাগজ। হাতে লাল নীল পেনসিল। ইদানীং তিনি খবর আন্ডার লাইন করা শুরু করেছেন। হত্যা, রাহাজানি, ধর্ষণ এইসব লাল রঙে দাগাচ্ছেন, পলিটিক্যাল খবরগুলো নীল রঙে। আমার জন্যে বেশ সুবিধা হয়েছে। আমি দাগ দেয়া খবর বাদ দিয়ে কাগজ পড়ি। পলিটিক্স-ফলিটিক্স আমার ভালো লাগে না।
বাবা চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। এমনভাবে তাকালেন যেন আমাকে চিনতে পারছেন না, তবে চেনা-চেনা লাগছে। তিনি গলা পরিষ্কার করলেন। ঠিকমতো পরিষ্কার হল না। কফ-জমা ভারি স্বরে বললেন, আমার জিনিসটা নিয়েছি?
আপনার কোন জিনিস?
ইউরিন স্যাম্পল। সুগার আছে কি না দেখবে। বাথরুমের কে আছে। একটা পলিথিন পেপার দিয়ে মুড়ে নিয়ে যা।
আমি স্তম্ভিত। যাচ্ছি এশার কাছে পকেটে থাকবে পলিথিনে মোড়া ইউরিন। স্যাম্পল। পিতৃদেবের মূত্ৰ।
অন্য কাউকে দিয়ে পাঠান বাবা, আমি একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি। খুবই জরুরি।
আমার কাজটা তাহলে তোমার কাছে তেমন জরুরি মনে হচ্ছে না? ভালো, ভালো, খুবই ভালো।
বাবার মুখ অন্ধকার। চশমা আরো খানিকটা স্কুলে পড়েছে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে জ্যেষ্ঠ পুত্রের হৃদয়হীনতায় তিনি মর্মাহত। আমি ইতস্তত করে বললাম, বাবলুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিন বাবা, ও ছাদে ক্যারাম খেলছে।
বাবা খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাকে পাঠাব তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি তোমার অত্যন্ত জরুরি কাজটি সেরে আস।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই নিয়ে যাচ্ছি।
তোমাকে নিতে হবে না।
আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন কেন?
তোমার সঙ্গে আমি এই প্রসঙ্গে আর একটি কথাও বলতে চাই না।
আমি খুব আহত হবার ভান করে বললাম, যাচ্ছি একটা চাকরির ব্যাপারে। পকেটে ইউরিন-ফিউরিন এই জন্যেই নিতে চাচ্ছিলাম না। না বুঝেই রাগ করেন।