আমাকে বিয়ে করতে চাইতি কেন? মিষ্টি খাওয়ার লোভে?
জানি না। হয়তো।
আগে কোনোদিন আমাকে বলিস নি কেন?
বললে কী হত?
অতসীদি জবাব দিলেন না। আবার হাসতে শুরু করলেন। তাঁর হাসির মাঝখানেই আমি বললাম, আমার কিন্তু এখনো তোমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছা করে।
অতসীদির হাসি থেমে গেল। তিনি অবাক হয়ে তাকালেন। তাঁর চোখ দুটি কী যে অদ্ভুত। মনে হয় জল থৈথৈ করছে। যেন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবেন। কেঁদে ফেলবার মতো আমি কি কিছু বলেছি? অতসীদিকে এমন কিছু বলার প্রশ্নই ওঠে না।
অতসীদি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, সব সময় ঠাট্টা করা ভালো না বীরু। বলেই তিনি মাথায় আঁচল তুলে দিলেন। হিন্দু মেয়েরা মাথায় আঁচল দিলে কেমন যেন লাগে।
তুই চলে যা বীরু। বাবা এলে পাঠিয়ে দেব।
অতসীদি ছোট-ঘোট পা ফেলে চলে গেলেন। রান্নাঘর থেকে খুটট শব্দ হতে লাগল। এ ছাড়া চারপাশ কি নীরব! আমি চলে গেলাম না। বসে বসে ধীরেন কাকুর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ধীরেন কাকু এলেন অনেকক্ষণ পরে। তাঁকে যতবারই দেখি, ততবারই মনে হয় আগের চেয়ে বুড়ো হয়ে গেছেন। ক্লান্ত জরাগ্রস্ত মানুষের মতো চলাফেরা। কথাবার্তায়ও প্ৰাণের স্পর্শ বলে কিছু নেই। যেন একটা রোবট যার ব্যাটারি ডাউন হয়ে যাওয়ায় কাজকর্ম শ্লথ হয়ে গেছে। তিনি আমাকে খুব ভালো করেই চেনেন, তবু বললেন, কে?
আমি। আমি বীরু।
ও, আচ্ছা। ঠিক আছে। কার অসুখ?
বাবার।
ও, আচ্ছা আচ্ছা। চল যাই। চল।
ধীরেন কাকু ডাঙায় ভোলা মাছের মতো ঘন-ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তাঁকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার সুযোগ দেওয়া উচিত। আমি না থাকলে হয়তো অতসীদি বাবাকে পাখা দিয়ে হাওয়া করতেন। ঠাণ্ডা পানির গ্লাস এনে সামনে রাখতেন। ধীরেন কাকু রাস্তায় নেমেই নিচু গলায় বললেন, আমার নিজেরও শরীরটা খারাপ।
ডাক্তাররা যখন বলেন, শরীরটা খারাপ তখন গোটা চিকিৎসা-শাস্ত্রটার উপর কেমন যেন সন্দেহের ভাব এসে পড়ে।
বাসায় ফিরে দেখি অল কোয়ায়েট ইন দা ইস্টার্ন ফ্রন্ট। পূর্ব দিগন্ত নিশ্রুপ। বাবার বিখ্যাত কামান-দাগানো কাশি বন্ধ হয়েছে। তিনি বারান্দার ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন—চোখে-মুখে প্রশান্ত ভাব। শেভ করেছেন। চুল আঁচড়ানো হয়েছে। চায়ের কাপে টোস্ট ড়ুবিয়ে মুখে দিচ্ছেন। সামনে আজকের খবরের কাগজ। যে-রকম মনযোগের সঙ্গে কাগজ দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে আজও সম্ভবত তাঁর কোনো চিঠি ছাপা হয়েছে। নাগরিক কোনো সমস্যা নিয়ে জ্বালাময়ী কোনো চিঠি ঝিকাতলা অঞ্চলে বখাটেদের যন্ত্রণা বিষয়ে কঠিন বক্তব্যের চিঠি।
ধীরেন কাকু বললেন, আবার কী হল?
ঐ কাশি। বড় বেড়েছিল। রাতে ঘুম হয় নি।
এখন কী অবস্থা?
এখন ভালোই। বয়স হয়েছে তো। বয়সের অসুখ।
ডায়াবেটিস আছে কি না দেখান। ইউরিনটা টেষ্ট করেন।
হয়েছে কাশি, ইউরিন টেস্ট করার কেন?
চেকআপের জন্য আর কী। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একটার সঙ্গে একটার যোগ আছে।
কাশিটার কী করবেন?
ক্রনিক অসুখে কবিরাজী খুব কাজ করে। পুরোনো ঘি বুকে মালিশ করে দেখতে পারেন। আমার কাছে এক শ বছরের পুরোনো ঘি আছে। পাঠিয়ে দেব।
ওষুধপত্র কিছু দেবেন না?
উঁহুঁ। ঘিটা মালিশ করে দেখেন। ওতেই আরাম হবে। উঠি তাহলে।
আরে না, উঠবেন কী? বসেন, চা খান। কথাটথা বলি। মেয়ের বিয়ের কিছু হল?
নাহ্। দেখি, পূজার সময় কোলকাতায় যাব। আমার এক শ্যালক আছে ধর্মতলায়, তাকে চিঠি দিয়েছি। খোঁজখবর করছে।
দেশে কিছু হচ্ছে না?
ধীরেন কাকু জবাব না-দিয়ে দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন। আমি চলে গেলাম নিজের ঘরে। আপাতত কিছু করার নেই। এক শ বছরের পুরোনো ঘি আনবার জন্যে আরেকবার যেতে হবে। সেটা এখনই না আনলেও হবে। যে ঘি এক শ বছর অপেক্ষা করতে পেরেছে, সে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে পারবে।
টেবিলের উপর একটা চিঠি পাওয়া গেল। পারুল চিঠিটা এমনভাবে রেখেছে যেন চট করে চোখে না পড়ে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে চিঠি খুলে সে পড়েছে। খামের মুখ দ্বিতীয় বার বন্ধ করা। আমি বিরক্ত মুখে খাম খুললাম।
চিঠি পড়বার সঙ্গে-সঙ্গে বিরক্তি কেটে গেল। গোপনে আমার চিঠি পড়ার জন্যে পারুলকে ক্ষমা করে দিলাম। খকখক কেশে আমার ঘুম ভাঙানোর জন্য ক্ষমা করলাম বাবাকে। জোর করে আমাকে ধীরেন কাকুর বাসায় পাঠাবার যে অপরাধ মা করেছেন, তার জন্য মাকেও ক্ষমা করা গেল।
তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে। খুবই জরুরি। তুমি সোমবার সকাল দশটা পাঁচ মিনিটে সায়েন্স ল্যাববারেটোরির পুলিশ বক্সের সামনে অপেক্ষা করবে। আবার ভুলে যে না। ইতি তোমার—এ।
তোমার—এ মানে তোমার এশা। এখা চিঠিপত্রে কখনো তার পুরো নাম লেখে না। যার কাছে চিঠি যাচ্ছে তার নামও থাকে না। এ ছাড়াও আরো কিছু ব্যাপার থাকে। যেমন, এই চিঠিতে সময় দিয়েছে দশটা পাঁচ মিনিট। দশটা লিখলেই হত, তা লিখবে না। গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য সঙ্গে পাঁচ মিনিট লাগিয়ে দিয়েছে। অপেক্ষা করবার জায়গাটাও চমৎকারপুলিশ বক্সের সামনে। পুলিশ বক্সের সামনে কেউ অপেক্ষা করে?
কেউ করে না। কিন্তু এশা করে। তার স্বভাবই হচ্ছে অদ্ভুত কিছু করা। একবার সে বলল, বুড়িগঙ্গায় নৌকায় কিছু ভাতের হোটল আছে, তুমি জান? খুবই নাকি ভালো রান্না। চল না, দুজন মিলে খেয়ে আসি।
যেতে হল। বুড়িগঙ্গায় নৌকার হোটেলে এশা মহানন্দে ভাত খেল। মোটা মোটা ভাত। টকটকে রঙের কী একটা মাছের ঝোল। ঝাল এমন দিয়েছে যে, চোখে পানি এসে যায়। কিন্তু এশার ধারণা, এমন চমৎকার রান্না সে জীবনে খায় নি। প্রতি সপ্তাহে একবার এসে খেয়ে যাওয়া উচিত।