ডাক্তার হচ্ছেন আমাদের ধীরেন কাকু। দীর্ঘদিন এই পাড়ায় আছেন। উনিশ শ পয়ষট্টি সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর দলবল নিয়ে কোলকাতায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। সুবিধা করতে না পেরে আবার ফিরে এসেছেন। এখানেও সুবিধা করতে পারেন নি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের সমস্ত দুর্বলতা ধীরেন কাকুর আছে। তিনি আশেপাশের সবাইকে খুশি রাখতে চান। বেশিরভাগ সময়ই ভিজিট নেন না। ভিজিট দিতে গেলে তেলতেলে একটা হাসি দিয়ে বলেন, আরে, আপনার কাছে ভিজিট কি নেব? ভাই। ভাই হিসেবে বাস করছি, কী বলেন? ঠিক না? আপনার বিপদে আমি আপনাকে দেখব, আমার বিপদে আপনি দেখবেন আমাকে। হা হা হা।
উনিশ শ একাত্তুরে ধীরেন কাকুকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেল। তখন আমাদের পাড়ার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হাজি আবদুল কাদের তাঁকে অনেক ঝামেলা করে ছুটিয়ে নিয়ে এলেন, এবং এক শুক্রবারে হাজি আবদুল কাদের ধীরেন কাকুকে মুসলমান বানিয়ে ফেললেন। নতুন মুসলমান ধীরেন কাকুর নাম হল মোহাম্মদ সুলায়মান। তিনি দাড়ি রাখলেন। চোখে সুরমা দেওয়া শিখলেন। মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে লাগলেন। একদিন বেশ ঘটা করে বাজার থেকে গরুর গোশত কিনে আনলেন। শান্তি কমিটির একটা মিছিল বের হল। সেখানেও টুপি মাথায় তাঁকে দেখা গেল। দেশ স্বাধীন হবার পর ধীরেন কাকু আবার হিন্দু হয়ে গেলেন। তবে দাড়ি ফেললেন না। দাড়িতে তাকে বেশ ভালো মানায়, কেমন ঋষি-ঋষি লাগে।
ধীরেন কাকুকে বাসায় পেলাম না। কলে গেছেন। তাঁর বড় মেয়ে অতসীদি বললেন, তুই বোস বীরু, বাবা এসে পড়বে। কার অসুখ?
পিতৃদেবের।
কী হয়েছে?
বক্কর-বক্কর করে কাশছে। মনে হচ্ছে লাংস ফুটো।
ছিঃ বীরু, বাবাকে নিয়ে কেউ এভাবে কথা বলে?
অতসীদি এত কোমলভাবে কথাগুলো বললেন যে, সত্যি-সত্যি আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। তিনি হয়তো খুব সাধারণভাবেই কথাগুলো বলেছেন। তাঁর চেহারা এবং গলার স্বরের জন্যেই সাধারণ কথাও অন্যরকম মনে হয়েছে। একজন স্নিগ্ধ চেহারার মেয়ের কর্কশ কথাও স্নিগ্ধ মনে হয়। অতসীদি এই ভোরেই গোসল সেরেছেন। তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল বাঁধা। চোখের দিকে তাকালে মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই গাঢ় করে কাজল দেওয়া হয়েছে। ঈশ্বর কোনো কোনো মেয়েকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত করুণা করেন। চোখে জন্ম-কাজল পরিয়ে দেন।
বীরু চা খাবি?
খাব।
চিনি নেই কিন্তু। বিনা চিনিতে।
বিনা চিনিতেই খাব।
নিয়ে আসছি, তুই বসে থাক। এরকম করে পা নাচাবি না তো, দেখতে বিশ্রী লাগে।
আমি বসে থাকি। অনেক দিন পর আসছি ধীরেন কাকুর বাড়িতে। ছোটবেলায় খুব আসা হত। আমার মূল আকর্ষণ ছিল মিষ্টি। এই বাড়িতে এলেই অতসীদি বলতেন, হাতটা ধুয়ে আয়, সন্দেশ দেব। সাবান দিয়ে ভালো করে ধুবি, নয়তো দেব না।
অতসীদির ছোট আরো তিন বোন ছিল। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। ধীরেন কাকু একেকজনকে কলকাতায় নিয়ে ঝামেলা পার করে এসেছেন। শুধু বড়জনকে পারেন নি। অথচ বড়জনই বোনদের মধ্যে সবচে সুন্দর। আমার মতে পৃথিবীর সবচে সুন্দর মেয়ে। শৈশবে প্রায়ই ভাবতাম, বড় হয়ে অতসীদিকে বিয়ে করব।
কে জানে মনে মনে হয়তো এখনো ভাবি, নয়তো তাঁকে দেখে এমন অস্থির লাগবে কেন?
চায়ের কাপ এবং একটা পিরিচে কী যেন একটা খাবার নিয়ে অতসীদি ঢুকলেন। রেশমের মতো কোমল গলায় বললেন, একটু মোহনভোগ এনেছি, খেয়ে দেখ তো। মিষ্টি বেশি হয়ে গেছে, তবে খেতে খারাপ না।
মোহনভোগ লাগবে না, তুমি চা দাও।
তোর চোখ এমন লাল হয়ে আছে কেন রে?
চোখে আলতা দিয়েছি, এর জন্য লাল হয়েছে।
দিনদিন তোর কথাবার্তা খুব খারাপ হচ্ছে। গুণ্ডাপাণ্ডা হয়ে গেছিস। তোর সঙ্গে একটা ছেলে আসত নাটুকু নাম। ওদেখি খুব বদমাশ হয়েছে। মদদ খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। ঐ দিন রিকশা করে আসছি। আমাকে পেছন থেকে দেখেছে, চিনতে পারে নি। খুব খারাপ একটা কথা বলেছে। আমি রিকশা থেকে নেমে বললাম, কী হচ্ছে রে টুকু? ওমি পালিয়ে গেল। ও করে কী এখন?
মেয়েদের হাত থেকে গলার হার, হ্যান্ডব্যাগ এইসব ছিনিয়ে নেয়।
তুই সবসময় এ রকম ঠাট্টা করিস কেন?
ঠাট্টা না। সত্যি কথা বলছি। ওর পেশা হচ্ছে ছিনতাই।
আমি অতসীদির হাতে হাত রাখলাম। কী রকম ঠাণ্ডা একটা হাত। ধবধবে ফর্সা। তাকালেই পবিত্র একটা ভাব হয়।
অতসীদি হাত সরিয়ে নিলেন না। অন্য কোনো মেয়ে হলে নিত। অতসীদি অন্য কোনো মেয়ে নয় বলেই সহজ গলায় বললেন, তোর হাত এরকম হয়েছে কেন? রগ-ওঠা হাত। বানরের থাবার মতো লাগছে।
মনে হয় বানর হয়ে যাচ্ছি। আমাদের পূর্বপুরুষরা বানর থেকে মানুষ হয়েছিল, আমরা মানুষ থেকে বানর হয়ে ঋণ শোধ করছি।
সব সময় উল্টাপাল্টা কথা বলিস কেন? আচ্ছা শোন, টুকুর সঙ্গে তোর দেখা হয়?
হয় মাঝে-মাঝে।
একবার বলিস তো আমার কাছে আসতে। কী রকম ছোট্ট ছিল। সব সময় নাক দিয়ে সর্দি পড়ত।
আমি চায়ের কাপ নামিয়ে হঠাৎ করে বললাম, একটা মজার কথা শুনবে অতসীদি?
তোর তো সব কথাই মজার, নতুন করে আর মজার কথা কি শোনাবি? সব মজার কথাই তো কয়েকবার করে শোনা।
এটা বিশেষ মজার।
বল শুনি।
আমি এবং টুকু—আমরা দুজন ছোটবেলায় ঠিক করেছিলাম বড় হয়ে তোমাকে বিয়ে করব।
অতসীদি খিলখিল করে হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতে তাঁর চোখে পানি এসে। গেল। তিনি সেই পানি মুছলেন না। কী অদ্ভুত দৃশ্য! অতসীদি হাসছে। আর টপটপ করে। তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।