টুকু লম্বা-লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে।
যখন কারো সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছ করে না তখনই টুকুর সঙ্গে দেখা হয়। তার হাত থেকে সহজ নিস্কৃতি বলে কোন কথা নেই। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে কথা বলবে। চলে যেতে চাইলে হাত চেপে ধরবে। পেছনে পেছনে আসবে।
টুকু সরু গলায় ডাকল, দোস্ত। আমি না শোনার ভান করলাম।
দোস্ত একটা কথা শুনে যা।
আমার কাছে টাকা-পয়সা নেইরে টুকু। দোস্ত-দোস্ত বললে কোন লাভ হবে না।
টাকাপয়সার দরকার নেই। আল্লাহর কসম। বিশ্বাস কর আমার পকেটভর্তি টাকা। দরকার হলে তুই কিছু নে সত্যি বলছি নে।
টুকু একগাদা এক শ টাকার নোট বের করল। চকচকে নোট। আমি হকচকিয়ে গেলাম।
দোস্ত তুই নে। কত লাগবে বল?
লাগবে না কিছু।
লাগবে লাগবে। চাচাজানের কথা শুনেছি। পানির মতো টাকা খরচ হবে। ডাক্তার ফাক্তার কত হাঙ্গামা। তার উপর ধর-আল্লাহু না করুক সত্যি-সত্যি যদি কিছু হয় তখন তো…..
আমি বহু কষ্টে নিজেকে সামলালাম। টুকুর উপর রাগ করা অর্থহীন। কেন রাগ করছি তা বোঝার ক্ষমতা তার নেই। আমি কঠিন স্বরে বললাম, পথ ছাড় টুকু, কাজ আছে।
এক মিনিট দোস্ত। জাস্ট ওয়ান মিনিট। একটা খুবই জরুরি কথা। তোর পায়ে ধরছি দোস্ত, শুনে যা।
টুকু সত্যি-সত্যি নিচু হয়ে আমার পা চেপে ধরল।
বল কী বলবি।
টাকা কীভাবে পেয়েছি সেটা বলব।
বলার দরকার নেই। বুঝতে পারছি।
তুই যা ভাবছি, তা না দোস্ত। আপঅন গড। মজুমদার সাহেব আমাকে টাকাটা দিয়েছেন। সন্ধ্যাবেলা ডাকিয়ে নিয়ে গেলেন। তারপর একটা খামের মধ্যে করে দিয়ে দিলেন। তিন হাজার এক শ টাকা।
কেন দিল?
সেটা বলে নি। বলেছে—টুকু, আমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে। আমি বললাম–দেব। তখন মজুমদার সাহেব খামটা দিলেন।
কাজটা কি?
সেটা তো দোস্ত বলে নি। পরে বলবে। অ্যাডভান্স পেমেন্ট। রাত আটটার সময়। যেতে বলেছে।
ভালোই তো, যা।
কিন্তু দোস্ত মনটা খারাপ। কী কাজ কে জানে!
মানুষ-মারা কাজ। কাউকে মেরে ফেলতে বলবে।
টুকু হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, পথ ছাড়। কাজ আছে। টাকাটা কি ফিরিয়ে দেব দোস্ত?
তোর ইচ্ছা।
ফেরত দেব কীভাবে? হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে। একটা গরম শাল কিনলাম।
ভালোই করেছিস, অস্ত্রপাতি লুকিয়ে রাখার জন্যে শাল হচ্ছে চমৎকার জিনিস।
টুকু ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলল। নিচু গলায় বলল, তুই কিছু টাকা রেখে দে দোস্ত। তোর কাছ থেকে এক টাকা দুটাকা করে মেলা নিয়েছি।
আমার লাগবে না। যাই রে টুকু।
টুকু আমার সঙ্গে-সঙ্গে আসতে লাগল। সে আসবেই। রিকশায় না-ওঠা পর্যন্ত সে আসবে। রিকশায় ওঠার পরও সে অনেকক্ষণ রিকশা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।
দোস্ত একটা বুদ্ধি দে। কী করব যাব মজুমদারের কাছে?
টাকা নিয়েছি, যাবি না মানে? না গেলে মজুমদার তোকে ছাড়বে?
যদি সত্যি-সত্যি মানুষ মারার কথা বলে, তখন কী করব?
একটা লম্বা ছুরি সাথে করে নিয়ে যা। তোর নতুন শালের আড়ালে লুকিয়ে রাখবি। মানুষ মারার কথা বললে ছুরিটা বের করে ওর ভুড়ির মধ্যে বসিয়ে দিবি।
ঠাট্টা করছিস কেন রে দোস্ত? একটা সিরিয়াস প্রবলেম।
ঠাট্টা করছি তোকে বলল কে? ওকে মারতে পারলে তোর আগের সব পাপ কাটা যাবে।
টুকু ফ্যাকাসেভাবে হাসতে লাগল। তার কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। থরথর করে ঠোঁট কাপছে। একটা হাত প্যান্টের পকেটে। এক শ টাকার চকচকে নোটগুলি সে নিশ্চয়ই এই হাতে ধরে আছে। নতুন নোটের স্পর্শের মতো আরামদায়ক আর কিছুই নেই। আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, চলি রে টুকু।
নিউমার্কেটে এশার সঙ্গে দেখা হল
নিউমার্কেটে এশার সঙ্গে দেখা হল।
কী সুন্দর তাকে লাগছে! এশা হচ্ছে সেই রকম মেয়ে, যাকে যেদিন দেখা যায় সেদিনই মনে হয় সে সাজের নতুন কোনো কায়দা করেছে—যার জন্যে তাকে অন্য যেকোনো দিনের চেয়ে সুন্দর লাগছে। আজ তাকে লাগছে ইন্দ্রাণীর মতো। হালকা নীল রঙের একটা শাড়ি। সেই নীলের ছায়া যেন চোখে পড়েছে। যেমন নীল-নীল লাগছে তার চোখ। সে নরম গলায় বলল, আমি ভেবেছিলাম তুমি আসতে পারবে না। তোমার বাবার শরীর কেমন?
ভালো।
সত্যি ভালোতো? আমি খুব খারাপ দেখেছিলাম।
এখন চমৎকার! খাওয়াদাওয়া করে বারান্দায় বসে আছেন।
আশ্চর্য তো!
একে বলে মিরাকুলাস রিকভারি। ধীরেনবাবু বলে আমাদের একজন ডাক্তার আছেন, তিনি যাকে বলে সাক্ষাৎ নীলরতন রায় কিংবা এই জাতীয় কিছু। এক ডোজ কী খাইয়ে দিয়েছেন-বাবা উঠে বসে বললেন, হুঙ্কা বোলাও।
ঠাট্টা করছ?
আরে না! বাবা অসুস্থ থাকলে আসতাম নাকি?
আমার কেন জানি মনে হয় অসুস্থ থাকলেও তুমি আসতে। পুলিশ-বক্সের সামনে যেতে বলেছিলাম। গিয়েছিলো, তাই না?
হুঁ।
তুমি যাবার কিছুক্ষণ পরই আমি গেলাম। এক পুলিশ অফিসার আমাকে খুব যত্ন করল। তোমার নাকি খুব বন্ধু।
বোসম ফ্রেন্ড। পুলিশের কোনো হেল্প লাগলে বলবে, ব্যবস্থা করে দেব। ডেকেছ কেন, ব্যাপারটা কি?
এক জায়গায় আমার সঙ্গে যেতে হবে।
কোথায়?
বলছি। খুব তৃষ্ণা লেগেছে। দাঁড়াও, পানি খেয়ে নিই। খুব ঠাণ্ডা পানি খেতে ইচ্ছা করছে।
ঠাণ্ডা পানি এখানে পাবে কোথায়?
পাব। ওষুধের দোকানগুলোতে ফ্রিজ থাকে। ওরা ফ্ৰিজে ঠাণ্ডা পানি রাখে। মিষ্টি করে চাইলে দেয়।
এশা এত মিষ্টি করে পানি চাইল যে, ফার্মেসির ছেলেটি বলল, আপা বসুন, পানি দিচ্ছি।
বসব না ভাই। এক জায়গায় যেতে হবে।