পিজি থেকে বের হয়ে পাশের একটা দোকানে ঢুকে লাচ্ছি খেলাম। লাচ্ছি শেষ করবার পরপরই মাসুম হাই তুলে বলল, দূর, ভালো লাগছে না, বাসায় চলে যাব। ঘুম আসছে।
তুই আমাকে খামোখা ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে এলি কেন?
এখন চলে যা, তা হলেই তো হয়! ঘ্যানঘ্যান করছিস কেন?
ইডিয়ট।
তুই শালা আরো বড় ইডিয়ট।
আমাকে আর দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মাসুম লম্বা-লম্বা পা ফেলে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল। শিস দিয়ে কী একটা গান গাইছে-ইয়ে মেরা সাংদিল। সাংদিল ব্যাপাটা কী কে জানে।
আমার তেমন কোন বন্ধু-বান্ধব নেই। মাসুমকে মাঝেমাঝে বন্ধু বলে মনে হয়। সেটা বোধহয় ঠিক নয়। সে সবারই বন্ধু—বিশ্ববন্ধু। প্রথম দিনের আলাপেই সে তুমিতে চলে যায়। এবং অবলীলায় বলে—একটা টাকা যদি থাকে দাও তো! বাসভাড়া নেই। অল গন। দ্বিতীয় দিন দেখা হলে সে তুই সম্বোধন করে। এক টাকার জায়গায় পাঁচ টাকা চায়। দিতে না-চাইলে পা ধরতে আসে।
এশার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় মাসুমের মাধ্যমে। টিএসসিতে গিয়েছি কি একটা কাজে, আমাকে দেখে মাসুম ছুটে এল, দোস্ত, আমাকে উদ্ধার কর। গভীর সমুদ্রে পড়েছি। ডিপ ওয়াটার।
কী হয়েছে?
একটা মেয়েকে কবি শামসুর রাহমানের বাসায় নিয়ে যা। আমার নিয়ে যাওয়ার কথা। যেতে পারছি না। আটকা পড়ে গেছি।
শামসুর রাহমান সাহেবের বাসা কোথায়?
আমি কী করে জানব কোথায়? কবি-সাহিত্যিকদের খোঁজ আমি রাখি নাকি। ঐসব হচ্ছে হাই থটের ব্যাপার।
ঐ মেয়েও কি হাই থটের নাকি?
আরে দূর দুর। কবিতা লিখেছে—পড়াতে চায় শামসুর রাহমান সাহেবকে। ভাই। তোর পায়ে ধরছি, নিয়ে যা রিকশা ভাড়া দেব!
কবি-মেয়ে নিয়ে যাব। পথে কোন বিপদে পড়ি কে জানে? যদি কবিতা শোনাতে চায়?
আরে দূর দূর, মেয়েমানুষ আবার কবি হয় নাকি? আয় পরিচয় করিয়ে দিই—ঐ দেখ পিচপিচ করে থুথু ফেলছে। কী সুন্দর করে থুথু ফেলছে দেখছিস? এই মেয়ের থুথু ফেলা দেখেই যে-কোনো ছেলে ওর প্রেমে পড়ে যাবে। কি, প্রেম-প্রেম লাগছে। না।?
আমি মাসুমের সঙ্গে এগুলাম। মাসুম হাসিমুখে বলল, এশা, আমার এই বন্ধু তোমার প্রেমে পড়ে গেছে। গভীর প্রেম।
এশা মাথার চুল ঠিক করতে করতে বলল, কী দেখে প্রেমে পড়ল?
তোমার থুথু ফেলা দেখে। কাইন্ডলি আরেকবার ফেল।
এশা সত্যি-সত্যি থুথু ফেলল। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, আরো ফেলতে হবে, না একটাতেই হবে? আমি জবাব খুঁজে পেলাম না। ধারালো, অথচ সুন্দর জবাব চট করে মাথায় আসে না। আসে অনেক পরে। এশার এই প্রশ্নের তিনটি চমৎকার উত্তর পরদিন আমার মাথায় এসেছিল, অথচ সেই সময়ে বোকা ধরনের একটি হাসি দিয়ে মাসুমের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি ফেললাম। মাসুম সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হাসিমুখে বলল, বীরু তোমাকে কবির বাড়িতে নিয়ে যাবে। বিখ্যাত লোকজনদের বাড়িঘর ওর মুখস্থ। এই বলেই সে হাওয়া।
কবির বাসা খুঁজে পেলাম না। আমি নিজেই অবশ্য বাসা খুঁজে পাবার ব্যাপারে তেমন কোনো উৎসাহ দেখাই নি। হয়তো বাসায় যাব, ভদ্রলোক কথাই বলবেন না। কিংবা মেয়েটির মুখের উপর বলবেন কিছু হয় নি। কবিতা চট করে লেখা যায় না। সাধনা দরকার। বেশি বেশি করে কবিতা পড়বে। চিন্ত করবে। চোখ-কান খোলা রাখবে। কবিরা উঠতি কবি দেখলেই চমৎকার একটা ভাষণ দেন। সেই ভাষণ শুনলে গা-জ্বালা করে। বলতে ইচ্ছ করে দূর শালা, কবিতাই লিখব না।
এটা অবশ্যি আমার কথা না। মাসুমের কথা। সে নাকি এরকম একটি ভাষণের পর এক কবিকে এই কথা বলে চলে এসেছিল। মাসুম একজন উঠতি কবি। এশার সঙ্গে সেই সূত্রেই খাতির। কবিতে-কবিতে ধুল পরিমাণ।
কবির বাসা খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসছি। এশা বলল, আপনি কি কবিতা পড়েন?
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ কিছুই পড়ি না। পড়বার ইচ্ছাও নেই।
এশা খিলখিল করে হেসে উঠল। আরো অনেকের মতে আমিও হাসি শুনেই এশার প্রেমে পড়ি। ওর থুথু ফেলা দেখে নয়। এত সুন্দর করে যে কেউ হাসতে পারে, আমার ধারণা ছিল না।
মাসুমের খোঁজে
মাসুমের খোঁজে গেলে কেমন হয়?
ব্যাটা থাকে সব সময় বাইরে-বাইরে, কিন্তু আমি যে কবার তার বাসায় গিয়েছি তাকে পেয়েছি। তার বাসায় যাওয়াও খুব সোজামগবাজারের বাসে উঠে পড়লেই। হয়। টঙ্গি ডাইভারশান রোডে নেমে দক্ষিণ দিকে মিনিট দশেক হাঁটা।
যাব নাকি মাসুমের কাছে? নাকি বাসায় ফিরে যাব? নাকি দুটার কোনোটাই না-করে অন্য কোথাও যাব? মাসুমের কাছে গেলে সময়টা অবশ্যি ভালো কাটবে। সত্যি-মিথ্যা মেশানো মজার-মজার কিছু গল্প শোনা যাবে। এবং এশার ব্যাপারেও হয়তো কিছু জানা যাবে।
মাসুমকে বাসায় পাওয়া গেল না। তার মামা ঘর থেকে বেরুলেন। খুবই অভদ্র গলায় বললেন, তুমি কে?
অন্য কেউ হলে আমি নরম গলায় বলতাম, আমি একজন মানব-সন্তান। কিন্তু এই ভদ্রলোককে এটা বলা যাবে না। তিনি মাসুমের একমাত্র গার্জিয়ান। বড় সরকারী চাকরি করেন। জয়েন্ট সেক্রেটারি বা এই জাতীয় কিছু। এঁকে চটিয়ে দেবার কোনো অর্থ হয় না। আমি বিনীত গলায় বললাম, আমি ওর একজন ক্লাসফ্রেন্ড। বন্ধু বলতে পারেন।
কী রকম বন্ধু?
বেশ ভালো বন্ধু।
তোমরা কি রকম বন্ধুবান্ধব এই জিনিসটা আমাকে বল।
ব্যাপারটা কী, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
আজকের খবরের কাগজ দেখ নি? তোমার বন্ধুর ছবি ছাপা হয়েছে। ফ্রন্ট পেইজে ছবি।