চা খাবার সময় লক্ষ করলাম, সে একবারও আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। একটা টাকা দিলাম চায়ের দাম। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে ক্যাশবাক্সে রেখে দিল। আমি বললাম, এশ কি এর মধ্যে এসেছিল? ঐ যে মেয়েটা আসে আমার সঙ্গে—রোগা, লম্বা, কাঁধে সব সময় একটা ব্যাগ।
আসে মাঝে-মইধ্যে।
একা?
না, চশমাওয়ালা একজন থাকে সাথে।
ছেলে না মেয়ে?
ছেলে। সুন্দর মতো একজন।
এই বলেই রমজান একটা উপহাসের হাসি হাসল। বোধহয় সে ভেবেছিল এটা শোনার পর আমি উ বলে চিৎকার করে বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ব। রমজান তাকাচ্ছে ট্যারা চোখে। আমি বললাম, চশমা পরা ছেলে? খুব ফর্সা?
হ।
ও হচ্ছে তার স্বামী। ওর নাম মুনীর।
রমজানের মুখ এবার হাঁ হয়ে গেল। এটা শোনার জন্যে সে বোধহয় প্রস্তুত ছিল না। মানুষকে পুরোপুরি বেকুব বানানোর একটা অন্যরকম মজা আছে। কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে ব্যাটা।
উনার বিহা হইছে?
হবে না? বয়স তো কম হয় নি! একটা ছেলে আছে, দু বছর বয়স—মন্টু নাম।
আফনে উনার কে হন?
কেউ হই না। খাতিরের লোক।
লোকটির দিকে তাকিয়ে চোখ টেপার একটা ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পারা গেল না। এই টেকনিকটা শিখতে পারি নি। চোখ টিপলে দুচোখ একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়।
আমি বেরিয়ে এলাম। রমজান ব্যাটাকে পুরোপুরি বেকুব বানানো যায় নি। সে গল্পটি বিশ্বাস করে নি। একটা ছেলে আছে বলে আমি ঘটনাটা কাঁচিয়ে ফেলেছি। ঐটা না বললে সে বিশ্বাস করত।
বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিথ্যা কথা বলা খুব কঠিন কাজ। আমার চেনাজানার মধ্যে এই কাজটা সবচে ভাল পারে মাসুম। মাসুমের চোখ বড়-বড়। সমস্ত চেহারায় ভালোমানুষি একটা ভাব আছে। সে চট করে নিজের চোখে পানি নিয়ে আসতে পারে। আমরা সবাই জানি মাসুমের স্বভাবই হচ্ছে মিথ্যা কথা বলা। তবু সে যখন কিছু বলে আমরা সঙ্গে-সঙ্গে বিশ্বাস করে ফেলি।
একদিন থার্ড ইয়ারের ক্লাস হচ্ছে। নবী স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। মাসুম দরজার সামনে এসে বলল, স্যার, একজন অ্যাকসিডেন্ট করেছে। পিজিতে আছে, খুবই খারাপ অবস্থা-ব্লাড দিতে হবে। বীরুকে একটু ছুটি দিন স্যার। বীরুর রিলেটিভ। বলতে-বলতে মাসুমের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। নবী স্যারের মুখ অসম্ভব করুণ হয়ে গেল। তিনি আমাকে ক্লাস থেকে বাইরে নিয়ে এসে বললেন, ডিপার্টমেন্টের সামনে আমার গাড়ি আছে। ড্রাইভারকে আমার কথার বল, তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। দেশের কী যে অবস্থা, প্রাণ হাতে নিয়ে পথে নামতে হয়। যাচ্ছি কোথায় আমরা?
আমি নিজেও তখনো বুঝতে পারি নি যে ব্যপারটা পুরোপুরি রসিকতা। আমার হাত-পা কাঁপছে। আমি ধরেই নিয়েছি, এ আর কেউ না—নিৰ্ঘাৎ বাবা, তিনি একটা কাণ্ড করেছেন। রিকশা থেকে ঝাঁকুনি খেয়ে পড়ে গেছেন। তখন হয়তো পেছন থেকে একটা ট্রাক এসেছে। ঘাতক ট্রাক। শহর ভর্তি ঘাতক ট্রাকে।
রিকশা থেকে গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাবার নামডাক আছে। বিনা ঝাঁকুনিতেও তিনি গড়িয়ে পড়ে যান। গত মাসেই এই কাণ্ড করে চশমা ভেঙেছেন। সাড়ে তিন শ টাকা লেগেছে চশমা সারাতে। এই টাকার চাপ সামলানোর জন্যে বাড়িভাড়া দেওয়া হয় নি। এখন চাপ দিচ্ছেন বাড়িওয়ালা। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যাতিন বেলা নিজে আসছেন কিংবা তাঁর ভাইস্তাকে পাঠাচ্ছেন। প্রতিবারই মা তাঁদের খুব সমাদর করছেন। চা-বিসকিট এইসব পাঠাচ্ছেন। দরজার আড়াল থেকে বলছেন, সামনের মাসের দুই তারিখে দু মাসেরটা একসঙ্গে মিটিয়ে দেব। এই মাসে একটু ঝামেলা হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না। এরকম তো কখনো হয় না। উনি বাড়িভাড়ার ব্যাপারে খুব সাবধান।
ইতং বিতং কত কথা মার। এইসব ঝামেলার কথাগুলি আমরা সবাইকে মাকে দিয়ে বলাই। পারুল একবার একটা ঝামেলা বাধালোপাড়ার নাটকে অভিনয় করবে। আমাদের গুষ্ঠিতে কেউ অভিনয়ের অ জানে না, কিন্তু সে পেয়ে গেল নায়িকার পার্ট। নাটকের নাম নয়া ফসল। খুবই বিপ্লবী জিনিস। মোড়ল-মারা নাটক। শেষ দৃশ্যে জাগ্ৰত জনতা গ্রামের মোড়লকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তখন নাটকের নায়িকা আলুথালু বেশে স্টেজের মাঝখানে ছুটে এসে বলে—এত অল্প রক্তে হবে না। চাই চাই, আরো রক্ত চাই। রক্তের নদী চাই, রক্তের সাগর চাই…ইত্যাদি।
রোজ রিহার্সেল। বিকেলে শুরু হয়, শেষ হতে হতে সন্ধ্যা। একদিন রিহার্সেলে কী হয়েছে কে জানে, পারুল কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরল। নাটক করবে না। নাট্য নির্দেশক, রোজ বাসায় এসে বসে থাকে। পারুল নিজে তার সঙ্গে কথা বলে না, মাকে পাঠায়। মা চিকন গলায় বলেন, ওর তো বাবা, গায়ে জ্বর। হামের মত গুটি-গুটি বের হয়েছে। ধীরেন বাবু ওষুধ দিচ্ছেন। তোমরা অন্য কাউকে দিয়ে নাটক করাও। ধীরেন বাবু বলেছেন—একে মাসখানিক রেস্ট নিতে হবে।
মাসুমের কথায় ফিরে যাই। ব্যাটা তো আমাকে বের করে নিয়ে এল। আমি ঠিকমতো পা পর্যন্ত ফেলতে পারছি না। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি হাসপাতালের বেডে বাবা লম্বা হয়ে পড়ে আছেন। স্যালাইন-ট্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। মা ঘন-ঘন ফিট হচ্ছেন।
মাসুম বলল, তোর কাছে সিগারেট আছে?
তখন বুঝলাম, ব্যাপারটা রসিকতা। মাসুম গলা নামিয়ে বলল, নবী স্যারের গাড়ি নিয়ে যাবি?
কোথায়?
ইয়াকুবের বাসায়। রু দেখব। মারাত্মক জিনিস। খালি বাসা। আমি, তুই আর ইয়াকুব। গেলে চল, সময় নষ্ট করতে পারব না।
স্যারের গাড়ি নিয়ে আমরা পিজি পর্যন্ত গেলাম। ড্রাইভারকে বললাম, ব্যাংক ভাই, স্যারকে বলবেন বড় উপকার হয়েছে। আমরা প্রায় দৌড়ে পিজিতে ঢোকার একটা ভঙ্গি করলাম। শেষ পর্যন্ত অবশ্যি ইয়াকুবের বাসায় যাওয়া হল না। মাসুম উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। কোন পরিকল্পনাই সে দীর্ঘসময় পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে না। উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।