আমি বললাম, এশার কথা থাক। পরীক্ষার ডেট পড়েছে?
হুঁ।
হুঁ মানে? সত্যি পড়েছে?
ইয়েস। সামনের মাসের সাত, আট আর নয়। তোর রোল নম্বর আগের দিকে, তোর সাত তারিখে হয়ে যাবে।
এই খবর এতক্ষণে দিচ্ছিস!
ইম্পৰ্টেন্ট খবর না, কাজেই দিচ্ছি না। ডেট পিছাবে। আবার নতুন ডেট পড়বে। ইতিমধ্যে কোনট-একটা গণ্ডগোল হবে। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। তুই নিশ্চিন্ত মনে এশার সঙ্গে চালিয়ে যা। বন্ধু, তুমি এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে।
রমিজ শব্দ করে হাসতে লাগল। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, শুধু শুধু হাসছিস কেন?
হাসি আসছে, কাজেই হাসছি। তোর কাঁদতে ইচ্ছে হলে কাঁদতে পারিস। নো প্রবলেম।
হাত ধোবার সময় দেখলাম হলের প্রভোস্ট সাহেব আসছেন। হাসিহাসি মুখে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলছেন। ছোটখাটো মানুষ। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিতে চমৎকার লাগছে। আটক করা গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এই আনন্দেই তিনি উল্লসিত। এক জন ছাত্র বলল, মানুষ মেরে পার পেয়ে যাবে, তা তো হয় না স্যার। কী বলেন?
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
প্রভোস্ট সাহেব তৃপ্তির হাসি হাসছেন। তিনি ঝামেলার হাত থেকে বেঁচে গেছেন। এরচেয়ে বড় সুসংবাদ কিছু হতে পারে না। এই সময়ে কেউ ঝামেলা সহ্য করতে পারে না। সবাই চায় ঝামেলাবিহীন দিন। প্রভোস্ট সাহেবের সঙ্গে দু জন চ্যাংড়ামত স্যার। তাঁদের চোখে-মুখে গভীর বিতৃষ্ণা, অথচ হাসিমুখে কথা বলতে চেষ্টা করছেন।
হলে মন টিকল না
হলে মন টিকল না। আবার বেরুম। এই সময় কোথাও মন বসে না।
যাবার জায়গা ঠিক করা নেই। খানিকক্ষণ হাঁটাহাটি করব। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ যদি কোথাও যাবার ইচ্ছা জাগে, তখন দেখা যাবে।
কড়া রোদ। আগুন-গরম বাতাস বইছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা। ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে, কারণ রাস্তার পিচ গলে আঠালো হয়ে আছে। স্যান্ডেলের সঙ্গে বেঁধে যাচ্ছে।
কড়া রোদে পথে নামলে অবধারিতভাবে আমার এশার কথা মনে হয়। তার সঙ্গেই রোদে হাঁটাহাঁটির ব্যাপারটা আমার রপ্ত হয়েছে। একদিন সে হঠাৎ এসে বলল, হাঁটতে তোমার কেমন লাগে?
খুব খারাপ। গাড়ি নেই এবং রিকশা ভাড়া নেই বলেই হাঁটি।
কড়া রোদে কখনো হেঁটে দেখেছ?
দেখব না কেন?
উঁহু, শখের হাঁটা না। দু ঘন্টা তিন ঘন্টা অনবরত হাঁটা। অদ্ভুত। অপূর্ব প্রথম কিছুক্ষণ খারাপ লাগবে। কান ঝাঁঝাঁ করবে। চোখে ঝাপসা দেখবে। তারপর দেখবে অন্যরকম লাগছে। সম্পূর্ণ অন্যরকম।
অন্যরকম মানে?
অন্যরকম মানে হচ্ছে–অন্যরকম। এস, আজ পরীক্ষা হয়ে যাক। নিজেই দেখ।
পাগল! আমি এই রোদে বেরুচ্ছি না। সান স্টোক হয়ে যাবে। এম এ পাশ করবার। আগে মারা গেলে বাবা-মা শোকে হার্টফেল করবেন। তারা এম এ পাশ পুত্র দেখতে চান।
তুমি এস তো আমার সঙ্গে।
যেতে হল। এশাকে অগ্রাহ্য করার মতো সাহস বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার নেই। আশ্চর্যের ব্যাপার, সত্যি-সত্যি অন্যরকম লাগল। মনে হল অপরিচিত কোনো শহরে আমরা চলে এসেছি। যার সবকিছুই অন্যরকম। ক্ৰমাগত তিন ঘন্টা হেঁটে বাসায় ফিরেই জ্বরে পড়লাম। জ্বরের মধ্যে মনে হত হাঁটছি। শুধুই হাঁটছি। সেই জ্বর সারতে এক সপ্তাহ লাগল।
এর পরেও এশার সঙ্গে গিয়েছি। ভরদুপুরেই যাওয়া। পুরোনো ঢাকার গলিতে-গলিতে হেঁটেছি। আমার ক্লান্তি লাগলেও তার ক্লান্তি নেই। আমি যদি বলি, চল, কোথাও বসে একটু রেস্ট নিই। এশা অবাক হয়ে বলে, এখনই টায়ার্ড? সবে তো যাত্রা শুরু।
প্লিজ, আর পারছি না।
চল, তাহলে, কোনো চায়ের দোকানে বসি।
কত বিচিত্র ধরনের চায়ের দোকানে এশাকে নিয়ে গিয়েছি। রাস্তার পাশে বট গাছের নিচে, সিঁড়ির নিচের খুপরিতে। একবার এক চায়ের দোকানি বলল, এইখানে মেয়েছেলে নিয়ে আসা যাবে না। অন্যখানে যান।
এশা বলল, মেয়েছেলে কী দোষ করল?
অসুবিধা আছে।
অসুবিধাটা কী সেটা বলুন। না বললে আমি যাব না। চিৎকার দেব।
দোকানদার বিস্মিত হয়ে বললে, চিৎকার দিবেন? চিৎকার দিবেন ক্যান?
আমাকে বসতে দিচ্ছেন না, এই জন্যে চিৎকার দেব। যে-সব জায়গায় ছেলেরা বসতে পারে সেখানে মেয়েরাও যেতে পারে। সমান স্বাধীনতা।
দোকানী বিরক্ত হয়ে বলল, আসেন, বসেন। চা খাইয়া বাড়িত যান।
সেই চায়ের দোকানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় লাগিয়ে আমরা চা খেলাম। এশা নানান কথা নিচু গলায় বলতে বলতে হাসতে লাগল। এ সব সে করছে দোকানদারকে রাগিয়ে দেবার জন্য। দোকানদারটা সত্যি-সত্যি রাগীরাগী চোখে তাকাচ্ছে? কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে আমাদের কাছ থেকে চার কাপ চায়ের দাম নিল না। আমি বললাম, চায়ের দাম নেবেন না কেন?
আমার ইচ্ছা আমি নিমু না। বড় যন্ত্রণা করছেন। অখন যান, বিদায় হন।
এর পরেও আমরা অনেকবার গিয়েছি। দোকানি প্রতিবারই বিরক্ত হয়েছে। কিন্তু কোনোবার পয়সা নেয় নি। কেন নেয় নি কে জানে! সব মানুষের মধ্যেই অনেক রকমের রহস্য থাকে।
রোদের তেজ মরে আসছে
রোদের তেজ মরে আসছে। এখন আর হাঁটতে ভালো লাগছে না। ঐ চায়ের দোকানটায় গেলে কেমন হয়? এক কাপ চা এখন নিশ্চয়ই খাওয়া যেতে পারে। আজ সে পয়সা নেবে কি না কে জানে। হয়তো নেবে। এশা সঙ্গে থাকলে নিত না। এই পরীক্ষাটাও হয়ে যাক। এশাবিহীন অবস্থায় কী হয়।
চায়ের দোকানির নাম রমজান। গোলগাল মুখ, মাথাভর্তি বাবরি চুল। চোখ দুটি আরো বড়-বড় হলে মধ্যবয়সের কবি নজরুল হিসেবে চালিয়ে দেয়া যেত। রমজান আমার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাল। হাই তুলে বলল, মুনশি, ইনারে চা দে।