আজও বেরুবার সময় মেয়েটিকে দেখলাম। বারন্দায় মোড়ায় বসে আছে, হাতে মোটা একটা বই। আমাকে দেখেই সে বই বন্ধ করে চোখ কুঁচকে ফেলল। যেন মহা বিরক্ত। অনু আপা আমাকে এগিয়ে দিতে আসছিল। আমি উঁচু গলায় বললাম, আপা, তোর শ্বশুরবাড়ির সবার মুখ কেমন যেন লম্বাটে। ছুঁচোর মতো। তোর পুত্রও এ রকম হয়েছে। ব্যাপারটা কি বল তো?
বলেই আমি আর দাঁড়ালাম না। লম্বা-লম্বা পা ফেলতে শুরু করলাম। মনে-মনে আশা করছি ঘাটা ঠিক জায়গায় গিয়ে লাগবে। একবার পিছন ফিরে দেখতে পারলে হত। সাহসে কুলুচ্ছে না।
মাথার উপর রোদ চড়চড় করছে।
কোথায় যাওয়া যায়? ভর-দুপুরে যাবার মতো জায়গা আমার খুব বেশি নেই। শহীদুল্লাহ হলের দিকে যাওয়া যায়। রমিজের কাছে। রমিজ তার নিজের রুমেই রান্না-বান্না করে। ভালোই করে। রুমভৰ্তি রান্না-বান্নার আয়োজন। শিলপাটা পর্যন্ত আছে। একটা কাজের মেয়ে মাঝেমাঝে এসে মশলা পিশে দিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর চমৎকার সব ব্যবহার হচ্ছে। কোনো কোনো রুম ভাড়া দেওয়া হয়েছে বাইরের ব্যাচেলর চাকুরিজীবীদের কাছে। তারা দিব্যি মাসের পর মাস থাকছে। ভাড়া, ছাত্রদের কোনো একটা বিশেষ দলের কাছে চলে যাচ্ছে। সুন্দর সিসেটম!
রাহাজানিছিনতাইয়ের দল তাড়া খেলে ঢুকে পড়ছে হলে। হল হচ্ছে অত্যন্ত পবিত্র জায়গা। এখানে পুলিশ ঢুকবে না। যে-কেউ এখানে কিছু দিন নিশ্চিন্তে থাকতে পারে।
রমিজকে তার ঘরে পাওয়া গেল। আমি বললাম, রান্না কী?
রমিজ বিরক্ত মুখে বলল, ইলিশ-সর্ষে। তুই ঠিক খাওয়ার আগে আগে আসিস কেন বল তো? ভাত সৰ্ট পড়বে।
পড়ুক।
গোসল করবি? গোসল করলে সেরে আয়। খিদেয় প্ৰাণ যাচ্ছে এক্ষুনি ভাত নিয়ে বসব।
হলের গেটের সামনে তুমুল হৈচৈ হচ্ছে। ফট করে একটা ফাঁকা গুলি হল। এক জন হকিষ্টিক নিয়ে দৌড়াচ্ছে। হকিস্টিকের মতো অচল অস্ত্র নিয়ে এই বেকুব কী করছে, কে জানে। আমি বললাম, গোলমাল হচ্ছে কিসের? কোনো সমস্যা আছে? রুম ভাঙাভাঙি হবে?
না, অন্য ব্যাপার। তেমন কিছু না। একটা গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। মালিককে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। আটক আছে। টাকা দিলে ছাড়া হবে।
কোন পার্টি ধরল?
জানি না। জাগ্রত ছাত্ৰ সমাজ হবে। বেচারার অবস্থা কাহিল। হেভি মারধোর হচ্ছে।
স্যাররা আসছেন না।
পাগল হয়েছিস। স্যাররা এখন বেরুবে? সব ঝামেলা মিটলে দু-এক জন উঁকি দেবে। জাগ্রত ছাত্ৰ সমাজকে ধমক দেবে, এমন সাহস কোনো স্যারের নেই। সব ভেড়ুয়া। ঝামেলা লাগলে স্ত্রীর আঁচলের বাতাস খায়।
অ্যাক্সিডেন্টে যে আহত হয়েছে, সে হলের ছাত্র নয়। বাইরের লোক। সে বাড়ি চলে গেছে। গাড়িওয়ালাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। এই ক্ষতিপূরণ কার কাছে যাবে কেউ জানে না।
আমি বন্দিকে এক নজর দেখতে গেলাম। ঠোঁট কেটে বিশ্রী অবস্থায় চোখ রক্তবর্ণ। সে খালিগায়ে শুধুমাত্র একটা আন্ডারওয়ার পরে বসে আছে। লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত গলায় বলল, আমি কিছুই করি নি। ফকির কিসিমের একটা লোক লাফ দিয়ে গাড়ির সামনে পড়ে গেছে। আমার অপরাধ কি বুঝলাম না। আর অপরাধ যদি হয়ে থাকে, বিচার হবে। আইন আছে। আদালত আছে।
এক জন ছাত্র এগিয়ে এসে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে কর্কশ গলায় বলল, মানুষ মেরে বড়-বড় কথা। আইন দেখায়।
মানুষ তো মরে নি ভাই।
চুপ থাক।
আপানারা কী করতে চান? মেরে ফেলতে চান?
চুপ থাক শালা। কুড়ি হাজার টাকা ফেল, তারপর কথা। সন্ধ্যার মধ্যে কুড়ি হাজার না পাওয়া গেলে পেট্রল দিয়ে গাড়ি পুড়িয়ে ফেলব। এই, পেট্রল নিয়ে আয়। মানুষ মেরে কথা বলে।
যান, গাড়ি পুড়িয়ে ফেলুন। একটা পয়সা দেব না।
তোর বাপ দেবে।
সাট আপ।
রোগামতো একটি ছেলে এসে আচমকা লোকটিকে একটা ধাক্কা দিল। সে গড়িয়ে পড়ে গেল। আমি সরে এলাম। সময় বদলে যাচ্ছে, এইসব এখন তুচ্ছ মনে হয়। কিছু দিন পর হয়তো দেখব পকেটমার ধরা পড়েছে—তার চোখ তুলে ফেলা হচ্ছে। ছেলেবুড়ো খুব আগ্রহ নিয়ে সেই দৃশ্য দেখছে। ঘন-ঘন হাততালি পড়ছে। এর নাম সময়। সময়কে গাল দেওয়া যাবে না। তোমরা সময়কে গাল দিও না। আমিই সময়। স্বয়ং আল্লাহু এই কথা বলেছেন। সময়কে কোনো দোষ দেয়া যাবে না।
ভাত খেতে খেতেই বুঝতে পারলাম একটা মিটমাট হয়েছে। লোকটা চলে যাচ্ছে। তাকে একজন কে নিতে এসেছে। লোকা তাঁর কাঁধে ভর দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি ভাবলেশহীন। এক জন ছাত্র বেশ মাইডিয়ার ভঙিতে বলল, গাড়ি ঠিকমতো বুঝে নিন, গাড়িতে টাচ করা হয় নি। যেমন ছিল তেমন আছে। নিন চাবি। এরপর থেকে গাড়ি সাবধানে চালাবেন। পাবলিকের হাতে পড়লে জান শেষ করে দিত। আমরা ধরে নিয়ে এসেছি বলে বেঁচে গেলেন।
লোকটি একটি কথারও জবাব দিচ্ছে না।
রমিজ বলল, সর্ষে-বাটা কেমন লাগছে? ভালো।
পাঁচফোড়ন ছিল না। পাঁচফোড়নের একটু টাচ দিলে দেখতি কী হত।
আমি অবাক হয়ে জিমকে লক্ষ করলাম। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে মোটও স্পর্শ করে নি। সে ঐ প্রসঙ্গে কোনো কথাই বলছে না।
বীরু।
কী
এশা তোক খুজছিল। খুব নাকি দরকার। আমার কাছে এসে তোর বাসার ঠিকানা চাইল।
বাসার ঠিকানা তো জানে। তোর কাছে আসার দরকার কি?
কীভাবে যেতে হয় জানে না। ডিরেকশন দিয়ে দিলাম। মসজিদের পাশে গলি। বাড়ির সামনে শিউলি গাছ। ঠিক আছে না?
আমাকে খুঁজছে কেন?
জানি না। বোধহয় এইবার প্রেম করতে চায়।
রমিজ গলা টেনে-টেনে হাসছে। এক সময় হাসি থামিয়ে বলল, অন্য কোনো ব্যাপারও হতে পারে। একটু চিন্তিত চিন্তিত মনে হল।