আপনাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে ভালো কথা। শুনে সুখী হলাম। আমাদের তো ছেলে পছন্দের একটা ব্যাপার আছে। বংশ দেখতে হবে, আচার-ব্যবহার দেখতে হবে। একটা মেয়েকে জন্মের মতো দিয়ে দেবনা দেখেশুনে দেই কীভাবে?
বাবার দেখাশোনা এবং বাছাবাছি চলতেই লাগল। কাউকে পছন্দ হয়, কথাবার্তা প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে আসে তখন বাবা বললেন, উঁহু, বংশে গণ্ডগোল আছে। সব কিছুর রুট হচ্ছে বংশ। ঐ জায়গায় গণ্ডগোল থাকলে সবই গণ্ডগোল।
আমরা দিন কাটাচ্ছি আতঙ্কের মধ্যে। গুজব রটে গেছে কে নাকি অ্যাসিডের বোতল নিয়ে ঘুরছে। সুযোগমত অনু আপার মুখে ঢালবে। সুযোগ পাচ্ছে না। অনু আপার বন্দিজীবন কাটছে। ঘর থেকে বেরুনো বন্ধ। জানালার পাশে যাওয়া বন্ধ। বারান্দায় দাঁড়ানো বন্ধ। বেচার শুধু কাঁদে আর হয়তো মনে-মনে ভাবে-একটা বিয়ে হোক, ঝামেলা শেষ হোক।
আমার প্রতিভাবান বাবা অনেক দেখেশুনে যে চিজটিকে বের করলেন, তার নাম ইসমাইল হোসেন। শ্রাবণ মাসে বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের সাত দিন পর অনু আপা ফিরাযাত্রায় এল। মা জিজ্ঞেস করলেন, বর কেমন রে?
অনু আপা মুখ শুকনো করে বলল, ভালোই। কিন্তু মারধোর করে। মা আকাশ থেকে পড়লেন, মারধোর করে মানে কী সর্বনাশের কথা! মারধোর করবে কেন?
জানি না মা
বাবা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, বেকুব মেয়ে, কী বুঝতে কী বুঝেছে। গায়ে ধাক্কাটাক্কা লেগেছে বোধহয়।
অনু আপা ঠিকই বুঝেছিল। লোকটা অসুস্থ নির্বিকার মারধোর করে। অথচ কথা বলবার সময় কী মিষ্টি-মিষ্টি কথা! হারামজাদা ছোটলোক।
কেমন আছিসরে আপা?
অনু আপা বলল, আমি ভালো আছি, তোর কী হয়েছে? এরকম লাগছে কেন তোকে?
কী রকম লাগছে?
অসুখ অসুখ লাগছে।
আমার শরীর ঠিকই আছে। বাবার অবস্থা কাহিল।
সে কী! কী হয়েছে?
ভয়াবহ কাশি। শতিনেক টাকা থাকলে দে। চলে যাব। সময় নেই।
দিচ্ছি, তুই বোস।
আমি অনু আপার বসার ঘরে বসে রইলাম। অনু আপা অদৃশ্য। এদের বাড়িটা এজমালি। তিন ভাই এবং দুববানের মধ্যে ভাগ হয়ে অনু আপাদের ভাগে দুতলার একটা বড় ঘর, একতলার দুখানা ছোট ঘর এবং দুতলার বারান্দার খানিকটা অংশ পড়েছে। দুতলার বড় ঘরটা দুভাগ করে বসার এবং শোবার ঘর করা হয়েছে। বারান্দায় রান্নার ব্যবস্থা। বিয়ের আগে বলা হয়েছিল সমস্ত বাড়িটাই আমার দুলাভাইয়ের। বাবাকে তারা বাড়ি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখিয়েছে। বাবা আবেগ আল্পত কণ্ঠে আমাদের এসে বলেছেন, রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি! বিরাট খানদানী ব্যাপার।
অনুর কপাল ফিরে গেল।
এই নে বীরু, খা।
অনু আপা প্লেটে করে দুখানা ভাজা ইলিশমাছের ডিম নিয়ে এল।
গরম-গরম ভেজেছি, খেয়ে ফে। টপ করে মুখে ফেলে দে।
টপ করে ফেলা যাবে না, আগুন-গরম। চামুচ আন, ধীরে সুস্থে খাই।
অনু আপা প্লেট নামাবার সঙ্গে-সঙ্গে অন্য হাতে অতি দ্রুত আমার পকেটে টাকা। চালান করে দিল। এর মানে দুলাভাই বাড়িতেই উপস্থিত।
দুলাভাই বাসায়?
হুঁ। অফিসে যায় নি। বীরু, ময়না ভাই, তুই ওকে রাগিয়ে দিস না।
আরে পাগল, আমি রাগাব কেন?
তুই ইচ্ছা করে ওকে রাগাস, পরে খুব যন্ত্ৰণা করে।
যন্ত্ৰণা করলে তুমিও যন্ত্রণা করবে। তোমাকে একটা চড় দিলে তুমি একটা চড। লাগাবে। সে যদি বাঁ পায়ে লাথি বসায় তুমি বসাবে ডান পায়ে। ফ্রিস্টাইল পদ্ধতি।
আস্তে কথা বলতো।
আমি উঠি আপা, অনেক কাজ।
ওর সঙ্গে দেখা না করে চলে যাবি কী যে অদ্ভুত কথাবার্তা তুই বলিস ও রাগ করবে না।
ঠিক আছে, বসছি। পাঠাও দুলাভাইকে। তোমার পুত্র কোথায়।
শাশুড়ির কাছে আছে। নিয়ে আসব?
কোনো দরকার নেই। শিশু জিনিসটাই আমার অসহ্য।
দুলাভাই হাসিমুখে ঢুকলেন। দু-এক দিনের মধ্যে চুল কাটিয়েছেন বলে মনে হল। দেখাচ্ছে অবিকল বানরের মত। যতই দিন যাচ্ছে লোটার চেহারা ততই কুৎসিত হচ্ছে। রহস্যটা কী, কে জানে।
বড় শ্যালক, খবর কি?
খবর ভালোই।
শ্বশুরসাহেবের অসুখ শুনলাম। সিরিয়াস নাকি?
না, সিরিয়াস কিছু না। আপনাকে এমন অদ্ভূত লাগছে কেন দুলাভাই? চুল কেটেছেন নাকি?
হুঁ। বেশি ছোট করে ফেলেছে। খুব খারাপ লাগছে?
লাগছে। বদরের মতো দেখাচ্ছে। দিন সাতেক ঘর থেকে বেরুবেন না। ঘরেই থাকুন। ঘরে বসে কাটলা খান।
কথাগুলো মুখ ফসকেই বলে ফেললাম। দুলাভাই সামনে থাকলে আমার নিজের উপর কোনো কন্ট্রোল থাকে না। কঠিন-কঠিন কথা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বলতে থাকি। আজকের ঠাট্টাটা মনে হচ্ছে একটু কড়া হয়ে গেছে। দুলাভাইয়ের মুখ থমথমে। ভাস্যিস অনু আপা সামনে নেই। থাকলে সে কী করত কে জানে। হয়তো কেঁদে-টেদে ফেলত। তবে দুলাভাই ব্যাপারটা ভালোই হজম করলেন। স্বাভাবিকভাবেই বললেন, অসুখের খবর দেবার জন্যে এসেছ, না অন্য কোনো উদ্দেশ্য?
আরেকটা উদ্দেশ্যও আছে। আপনার কাছে কিছু টাকা হবে দুলাভাই?
কিছু মানে কত?
এই ধরুন হাজার পাঁচ।
মাথা খারাপ হয়েছে? দশ-বিশ হলে দিতে পারি।
বেশ, তাই না হয় দিন।
দুলাভাই বিরস মুখে একটি কুড়ি টাকার নোট বের করলেন। আমি বললাম, উঠি দুলাভাই?
এই বাড়িতে ঢাকা এবং বের হওয়া দুইই বিরক্তিকর। নানান ঘর-দুয়ার পার হতে হয়। অপরিচিত সব মহিলারা সামনে পড়ে যায়। তারা এমনভাবে তাকায়…. বিশেষ করে দুলাভাইয়ের এক বোন মলিনা না ফলিনা কী যেন নাম। আমার সঙ্গে তার অনেক বারই দেখা হয়েছে। দেখা হওয়ামাত্র সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়,ভূ কোঁচকায়। সামনে থেকে বিশ্রী ভঙ্গিতে উঠে চলে যায়। এ রকম ভাবে উঠে যায়, যে নিজিকে খুব ছোট মনে হয়।