এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে ঢাকা শহরে আমার যাবার কোনো জায়গা নেই। বাবার ইউরিন-ভর্তি শিশি পকেটে নিয়ে আমি ঢাকার রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াব। এই বোধহয় আমার নিয়তি। বাবার পেচ্ছাবের শিশি পকেটে আছে বলেই কি এরকম হচ্ছে? অসম্ভব নয়। সব জিনিসেরই কিছু-না-কিছু আছর আছে। There are many things in heaven and earth….. স্বয়ং শেক্সপিয়ারের কথা। শিশিটা পকেট থেকে ফেলে দিলে কেমন হয়? এটা তো এমন মহামূল্যবান কিছু নয়। কালও জোগাড় করা যেতে পারে। এবং সেটাই বোধহয় ভালো হবে। ফ্রেশ জিনিস নিয়ে ডাক্তারের কাছে পৌঁছে দেব। এমিতেই তো এই বস্তু অনেকক্ষণ পকেটে আছে, বাসি হয়ে যাবার কথা। তবে কে জানে মলমূত্র হয়তো যত বাসি হয় ততই ফ্রেশ হয়।
আমি শিশিটা নর্দমায় ফেলে দিলাম। আশ্চর্য কাণ্ড ফেলে দেবার পরপর মনে হল আমি একটা অন্যায় করেছি। বেচারা বাবা হয়তো অপেক্ষা করে থাকবে।
অল্প সময়ের মধ্যেই অপরাধবোেধ আমাকে কাবু করে ফেলল। এর হাত থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায় হচ্ছে কোনো-একটা কাজ করা। অন্ধকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দেওয়া জাতীয় কিছু। কিংবা মার কথামতো নাখালপাড়া চলে যাওয়া। বাবার কাজটি করতে না-পারার অপরাধ মোচন হবে মার কাজটি নিখুঁতভাবে যদি করা যায়।
নাখালপাড়া যাওয়াটা কোনো সমস্যা নয়। গুলিস্তানে গেলেই টেম্পো পাওয়া যাবে। চমৎকার জিনিস। আধুনিক ঢাকার যানবাহনের জগতে বিপ্লব। একের মধ্যে কুড়ি। ইদানীং আবার মহিলারা উঠতে শুরু করেছেন। আগে উঠত মাতারিশ্রেণীর মহিলা। ওদের দেশে-দেখে ভরসা পেয়ে আধুনিকারা উঠতে শুরু করেছেন। এমিতে তাঁদের গায়ের সঙ্গে একটু ছোঁয়া লাগলেই ছাৎ করে ওঠেন। টেম্পোতে অন্য ব্যাপার। গায়ের সঙ্গে গা লেপ্টে থাকে, তবু আধুনিকারা শব্দ করেন না। চোখে চোখ পড়লে বড় বোনসুলত হাসি দেন। মেয়ে যাত্রী যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে মহিলা টেম্পো চালু হবে। এরশাদ সাহেবের মহিলাবিষয়ক কোনো মন্ত্রী এসে শুভ উদ্বোধন করবেন। গলা কাঁপিয়ে একটি ভাষণ দেবেন—এ দেশের নির্যাতিত অবহেলিত নারীজাতির জন্যে আজ একটি ঐতিহাসিক দিন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনটির কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মহিলাদের স্বাধিকার অর্জনের একটি ধাপ হচ্ছে এই মহিলা টেম্পো। আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা জনগণের চোখের মণি আলহাজ্জ হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ মহিলাদের জন্যে যা করেছেন, তা অতীতে কেউ করেন নি, ভবিষ্যতেও কেউ করবে না। এই যে কুৎসিত যৌতুক প্রথা……
মহিলা বিষয়ক মন্ত্রীর ভাষণ সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে আমি একটি টেম্পোতে উঠে পড়লাম। টেম্পো ছাড়বার সঙ্গে-সঙ্গে রাজনীতি শুরু হয়ে গেল। দেখা গেল প্রাণপ্রিয় নেতার দিন যে শেষ, এই বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। একজন খবর দিল লন্ডনে একটি হোটেল কেনা হয়েছে। নেতা দেশ ছেড়ে দিয়ে সরাসরি হোটেলের ম্যানেজারি শুরু করবেন। সেই হোেটলে উন্নতমানের বাংলাদেশি খাবার সরবরাহ করা হবে।
ঘড়িতে বাজছে বারটা দশ। অনু আপার বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে বারটা বেজে যাবে। এটা বেশ ভালোই হল। দুলাভাই নামক প্রাণীটির সঙ্গে দেখা হবে না। তিনি থাকবেন অফিসে। দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে না, এই আনন্দেই টেম্পোযাত্রার কষ্ট সহ্য করা যায়।
আমার দুলাভাই লোকটি অতি ভদ্র। তাঁর আচার-ব্যবহার সবই মোলায়েম। তাঁর সবকিছুই সূক্ষ্ম রুচিবোধ সূক্ষ্ম, বুদ্ধি সূক্ষ্ম, চিন্তা-ভাবনা সূক্ষ্ম এমনকি তার গোঁফ জোড়াটাও সূক্ষ্ম। জোৎস্না দেখবার জন্যে তিনি ছাদে বসে থাকেন। মাসে এক বার গ্রুপ থিয়েটারের নাটক দেখেন। গ্ৰন্থমেলা থেকে কবিতার বই ছাড়া কিছু কেনেন না। বাসায় রবীন্দ্রনাথের বিরাট ছবি। ২৫শে বৈশাখ এবং ২২শে শ্রাবণ এই দুদিন রবীন্দ্রনাথের ছবিতে মালা দেয়া হয়।
দুলাভাইয়ের তুলনায় অনু আপার সব কিছুই স্থূল ধরনের। বুদ্ধি স্থূল। আচারআচরণও সেই রকম। শরীরও মোটা। অবশ্য মোটাটা ইদানীং হয়েছে। আগে ছিল ছিপছিপে ধরনের। বুদ্ধির অভাব অনু আপা রূপ দিয়ে বহুগুণে পুষিয়ে দিয়েছিল। কাটাকাটা চোখ-মুখ। বইপত্রে কাঁচাহলুদ বর্ণের যে-সব নায়িকাদের কথা থাকে, তাদের সবার চেয়েই অনু আপা সুন্দর। সুন্দরী মেয়েদের বোকা-বোকা কথাও শুনতে ভালো লাগে, এটা বোধহয় সত্যি। অনু আপার মুগ্ধ ভক্ত প্রচুর জুটে গেল। বিরাট যন্ত্রণা! অনু আপা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে গেছে। তাকে নকল সাপ্লাই দেবার জন্যে সঙ্গে গেল এ পাড়ার ছসাত জন ভক্তের একটা জঙ্গীদল। কোন খাতা কার কাছে যাবে, সেই খবরও এক জন নিয়ে এল। এত করেও লাভ হল না। অনু আপা ম্যাট্রিক পাশ করতে পারল না।
তাতে অসুবিধা তেমন হল না।
বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে লোকজন আসতেই লাগল। প্রায় বিকেলেই দেখা যেত বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে। সেই গাড়ি থেকে মোটা ধরনের গয়নায় মোড়া মহিলারা বের হচ্ছেন। তাঁদের সবার মুখে তেলতেলে একটা ভাব। বাংলাদেশে রূপবতী মেয়েদের যে আকাল যাচ্ছে, তা এই প্রথম আমরা বুঝলাম। প্রফেসর, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্মি অফিসার। কত রকম ঝোলাঝুলি, ধরাধরি। বিশ্রী ব্যাপার।
বাবা খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। অহঙ্কারী-অহঙ্কারী একটা ভাব চলে এল তাঁর মধ্যে। এ রকম রূপবতী একটি কন্যাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন—অহঙ্কার হবারই কথা। তাঁর কথাবার্তার ধরন পর্যন্ত বদলে গেল। পাত্রপক্ষের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলবার সময় তাঁর গলার স্বর কেমন সরু হয়ে যেতে শুরু করল।