ইমনকে যে বাংলাদেশে আনা হয়েছে তা সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শেই আনা হয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছেন সব শিশুই একজন ফাদার ফিগারের অনুসন্ধান করে। মার কাছে সে চায় আশ্রয়। বাবার কাছে নেতত্ব। নির্দেশনা। এক সময় আমাদের আদি পূর্বপুরুষরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বনে-জঙ্গলে অসহায় জীবনযাপন করত। নেতৃত্বের ব্যাপারটা তখনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। একজন ভালো নেতার দলে থাকলেই সারভাইভেলের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। অতি প্রাচীন এই ধ্যান-ধারণা জিনের মাধ্যমে বর্তমান মানুষদের মধ্যেও চলে এসেছে। এখনো মানুষ খোজে নেতা।
সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক হাসিমুখে খুব গুছিয়ে কথা বলেন। তাঁর প্রতিটি কথাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।
ম্যাডাম, আপনি আপনার পুত্রকে কিছুদিনের জন্যে হলেও তার বাবার কাছে ফেলে রাখুন। তার ফাদার-ফিগার অনুসন্ধান তৃপ্ত হোক।
কিছুদিন ফেলে রাখলেই হবে?
কিছুটা তো হবেই। তার বাবা যদি বুদ্ধিমান হন, তাহলে ছেলের সমস্যা ঠিক করে ফেলতে পারবেন। তার বাবা কি বুদ্ধিমান?
হ্যাঁ, বুদ্ধিমান। তার অনেক কিছুর অভাব আছে, বুদ্ধির অভাব নেই।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, সেই ভদ্রলোকের কী কী অভাব আছে, একটু বলুন তো। নোট করি।
তার প্রয়োজন আছে কি?
হ্যাঁ প্রয়োজন আছে।
সে সবসময় নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আশেপাশের কাউকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবে না। সে মনে করে সে নিজে যা ভাবছে, তা-ই ঠিক।
সাইকিয়াট্রিস্ট হেসে বললেন, সব মানুষই কিন্তু এরকম। কেউ একটু বেশি কেউ কম। এখন বলুন, এই ভদ্রলোককে কি আপনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন?
হ্যাঁ।
তার কোন গুণটি দেখে তাকে ভালোবেসেছিলেন?
রেবেকা ভুরু কুঁচকে বসে রইলেন। প্রশ্নটার জবাব দিতে তার ইচ্ছা করছিল না। সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ সহজভাবে কথা বলুন। আপনিও যদি আপনার ছেলের মতো চুপ করে থাকেন, তাহলে কীভাবে হবে! প্লিজ স্পিক আউট। তাকে কেন বিয়ে করলেন সেটা বলুন।
আর্ট কলেজে একবার ফোর্থ ইয়ারের ছেলেদের এক্সিবিশন হচ্ছে। আমি কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ছবি দেখতে গেছি। একটা ওয়েল পেইন্টিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে আমি হতভম্ব। ছবিটা জঙ্গলের ছবি। গভীর জঙ্গলে একটি তরুণী মেয়ে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছে মেয়েটির মুখে। খুবই সুন্দর ছবি। চোখ ফেরানো যায় না এমন ছবি। কিন্তু আমি হতভম্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। বনের ভেতর যে মেয়েটা শুয়ে আছে সে আমি। আমার চোখ, আমার মুখ। আমার মাথার চুল লালচে ধরনের। মেয়েটির মাথার চুল ও সেরকম। আমি কিছু বলার আগেই আমার বান্ধবীরা চেঁচিয়ে বলল, এ কী এটা তো তোর ছবি!
আমি আর্টিস্টকে খুঁজে বের করলাম। তার চেহারা সুন্দর। কথাবার্তা সুন্দর। স্বপ্ন স্বপ্ন চোখ। কোনো একটা মজার কথা বলার আগে মানুষের মুখে যে-রকম এক্সপ্রেশন হয়, তার মুখের এক্সপ্রেশন সেরকম। যেন এক্ষুণি সে মজার কোনো কথা বলবে। আমি তাকে গিয়ে বললাম, আপনার ছবির এই মেয়েটি কি আমি? সে অবাক হয়ে বলল, আপনি হবেন কেন? আমি আপনাকে চিনি না। আপনি আমার ছবির জন্য মডেলও হন নি।
আপনি বলতে চান পুরো ছবিটা আপনি মন থেকে এঁকেছেন?
না, আমি মন থেকে আঁকি নি। মধুপুর শালবনে রঙ-তুলি নিয়ে গিয়েছি। ছবিটার কাঠামো সেখানে করা।
মেয়েটির ছবি মন থেকে এঁকেছেন?
জি।
আপনি আপনার নিজের ছবির দিকে তাকান এবং আমার দিকে তাকান, তারপর বলুন ছবিটির মেয়ে এবং আমি দুজন কি একই ব্যক্তি?
অস্বাভাবিক মিল তো আছেই।
মিল কেন হলো?
ছেলেটা তখন হেসে বলল, হয়তোবা কোনো না কোনোভাবে আপনি আমার কল্পনায় ছিলেন। আপনার সঙ্গে কল্পনার জগতে আমার পরিচয় আছে। মিল দেখে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আপনার তো উচিত খুশি হওয়া।
আমি রেগে গিয়ে বললাম, আমি কেন খুশি হবো? এই ছবিটা কেউ একজন কিনে নিয়ে তার ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখবে। আমি একজন মানুষের ড্রয়িংরুমে শুয়ে থাকব, যাকে আমি চিনি না।
অন্যের ড্রয়িংরুমে আপনি শুয়ে থাকবেন কেন? আপনি ছবিটা কিনে নিয়ে যান। আপনার শোবার ঘরে টানিয়ে রাখুন। আপনি শুয়ে থাকবেন আপনার শোবার ঘরে।
ছবিটার দাম কত?
দাম লেখা আছে পনের হাজার টাকা। তবে আপনি যা দেবেন আমি তা-ই নেব। খুবই টাকা-পয়সার টানাটানিতে আছি। একটা ছবি বিক্রি করতে না পারলে কলেজের বেতন দিতে পারব না। খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ।
আমি সেই দিনই পনের হাজার টাকা দিয়ে ছবি কিনলাম। আমার ইচ্ছা ছিল ছবি নিয়ে বাড়ি ফেরা, সেটা সম্ভব হলো না। যতদিন এক্সিবিশন চলবে ততদিন ছবি রাখতে হবে। তবে আমি ছেলেটির সঙ্গে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে গেলাম। সেই লাঞ্চ করতে যাওয়াটাই আমার জন্যে কাল হলো। ছেলেটা হঠাৎ বলল, এত অল্প বয়েসী কোনো মেয়ে যে তার ব্যাগে এতগুলো টাকা নিয়ে ঘুরতে পারে তা তার কল্পনাতেই নেই। এটা বলেই সে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, কল্পনার জগতে আপনার সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় ছিল। সেই জগতে আমরা দুজন হাত ধরাধরি করে হাঁটতাম। এখন আমরা বাস্তবে বাস করছি। আমি কি বাস্তবের এই মেয়েটাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি? তার কথা শুনে আমার হঠাৎ কী যেন হলো, আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, কোনো সমস্যা নেই, ছুঁয়ে দেখুন।
অতি দ্রুত আমরা বিয়ে করে ফেললাম। আমার বাবা, আমার আত্মীয়স্বজনরা আমার উপর খুবই রাগ করলেন। কোর্টে বিয়ে করে মাকে যখন খবর দিলাম, তখন তার স্ট্রোকের মতো হলো। But I was happy.