উড়িয়া যায়রে প্রাণপাখি তিন দরজা দিয়া
খবর আইছে প্রাণপাখির আইজ সইন্ধ্যায় বিয়া॥
মানুষটার প্রাণপাখি তিন দরজা দিয়ে বের হয়ে বিয়ে করতে যাবে। তখন আনিকার কী হবে! সে বিধবাদের সাদা শাড়ি পরে অন্য কোনো সেকেন্ডহ্যান্ড পুরুষের সন্ধানে বের হবে? তার জীবন কেটে যাবে সন্ধানে সন্ধানে? সেকেন্ড হ্যান্ড, থার্ড হ্যান্ড, ফোর্থ হ্যান্ড।
শওকতের টাকা-পয়সাও নেই। ঘরে টিভি নেই। গান শোনার যন্ত্র নেই। শোবার ঘরে একটা ফ্যান আছে, সেখান থেকে সারাক্ষণ কটকট ঘটঘট শব্দ হয়। মিস্ত্রি ডাকিয়ে ফ্যান সারাবে— সেই পয়সাও হয়তো তার নেই।
মানুষটার বাসা ভাড়া করার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই। অন্যের বাসায় থাকে। ঠিক অন্যের বাসাও না— তার মামার বাসা। মামা-মামি থাকেন দেশের বাইরে। তারা শ্যামলীতে সাত কাঠা জায়গা কিনে দুই কামরার টিনের একটা হাফ বিল্ডিং বানিয়ে শওকতকে পাহারাদার হিসেবে রেখে দিয়েছেন। যেন জমি অন্য কেউ দখল নিতে না পারে। মামা-মামি দেশে ফিরে এই জমিতে বাড়ি করবেন। তারা যে-কোনো দিন দেশে চলে আসবেন। তখন শওকতের কী হবে? মামা-মামি অবশ্যই গলাধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দেবে। সে যাবে কোথায়? কাক-বকগাছপালা এঁকে কি কোনো মানুষ জীবন চালাতে পারে? শওকত একটা পেন্সিল হাতে নিয়ে একটানে একটা ছাগল এঁকে ফেলতে পারে। তাতে লাভ কী? ছাগল আঁকার দরকারটাই বা কী! ক্যামেরায় ছাগলের ছবি তুললেই হয়।
অনেকদিন পর তার ছেলেটা তার সঙ্গে কয়েকদিন থাকবে। ভালো-মন্দ কিছু যে সে এই ছেলের জন্যে করতে পারবে তা তো মনে হয় না। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা দিনরাত টিভি দেখতে চায়। তার উচিত ছোট হলেও একটা রঙিন টিভি কেনা। সুন্দর সুন্দর কিছু বিছানার চাদর কেনা। কিছু খেলনা কেনা।
আনিকা ঠিক করে ফেলল, কাল অফিস থেকে ফেরার পথে শওকতের বাসায় যাবে। একটা খামে কিছু টাকা ভরে দরজার নিচ দিয়ে ফেলে দেবে। সাদা মুখবন্ধ খাম দেখে শওকত বুঝতে পারবে না টাকাটা কোত্থেকে এসেছে। বোঝার দরকারই বা কী?
কত টাকা দেয়া যায়? পাঁচ হাজার। টিভি কিনতে চাইলে পাঁচ হাজারে হবে। দশ হাজার দেয়া দরকার। আনিকার টাকা আছে। প্রতি মাসেই সে বেতনের টাকার একটা অংশ জমায়। বোনাসের টাকার পুরোটাই জমায়। দুই লাখ এগারো হাজার টাকা তার জমা আছে। টাকাটা সে জমাচ্ছে বিয়ের জন্যে। নতুন সংসার শুরু করতে কত কিছু লাগে। প্রতিটি খুঁটিনাটি জিনিসের জন্যে সে তো আর শওকতের কাছে হাত পাততে পারবে না। অবশ্যি যদি শওকতের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
আনিকা বাসায় ফিরল সন্ধ্যা সাতটায়। তাকে দেখে তার মা মনোয়ারা ছুটে এসে বললেন, ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়েছে। এক লোক বাসায় টেলিফোন করে তোর বাবাকে হামকি ধামকি করেছে। শুণ্ডাদের মতো মোটা গলা। তোর বাবা ভয়ে অস্থির। ভীতু মানুষ তো!
আনিকা বলল, বাবাকে হামকি ধামকি করবে কেন?
মনোয়ারা বললেন, মিতুকে তোর বাবা মেরেছে–সেই খবর পেয়ে টেলিফোন। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবা যদি তার মেয়েকে মারে, বাইরের লোক হামকি ধামকি করবে কেন?
মিতু কী বলে?
সে বলে, আমি কিছু জানি না।
মিতু কোথায়?
দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে আছে। অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাধাক্কি করছি। দরজা খুলছে না। সাড়া-শব্দও করছে না। ঘুমের ওষুধ-টষুধ কিছু খেয়েছে কি-না কে জানে। তুই একটু দেখবি?
আনিকা বলল, আমি কিছু দেখতে-টেখতে পারব না মা। আমার জ্বর। আমি গরম পানি দিয়ে গোসল করে শুয়ে থাকব।
জ্বরের মধ্যে গোসল করবি কেন?
গা ঘিনঘিন করছে। এই জন্যে গোসল করব।
গোসল করতে করতে আনিকা শুনল, তার মা মিতুর ঘরের দরজা খোলার জন্যে খুবই চেষ্টা চালাচ্ছেন। মা দরজা খোল। তোকে কেউ কিছু বলবে না। আচ্ছা যা, দরজা না খুললে খুলবি না, একটু কথা বল। তোর বাবাকে যে টেলিফোন করেছে, সেই ছেলেটা কে?
মিতুর ঘর থেকে কোনো শব্দ আসছে না।
রেবেকা ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন
রেবেকা ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইমন বসে আছে মেঝেতে। তার হাতে কাঁচি। সামনে কিছু লাল-নীল কাগজ, আইকা গাম। কাগজ কাটার চেষ্টা করছে কিন্তু কাঁচি ঠিকমতো ধরতে পারছে না। অনেক বয়স্ক মানুষই কাঁচি ঠিকমতো ধরতে পারেন না। ন বছর বয়েসী একটা ছেলের পারার কথা না। রেবেকা একবার ভাবলেন— ছেলেকে ডাক দিয়ে কাছে বসিয়ে কাঁচি ধরা শিখিয়ে দেবেন। তারপর মনে হলো প্রয়োজন নেই। শিখুক নিজে নিজে। ভুল করে করে শিখবে। Through mistakes we learn. এটাও অনেকে পারে না। অনেকে সারাজীবন ভুলই করে যায়। কিছু শিখতে পারে না।
রেবেকা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, Hello! ছেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর কাগজ কাটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ইমন কথা খুব কম বলে। সে চেষ্টা করে প্রশ্নের জবাব ইশারায় দিতে। যে সব প্রশ্নের জবাব ইশারায় দেয়া যাবে না–সেইসব প্রশ্নের জবাব সে দেয়, তবে অনাগ্রহের সঙ্গে দেয়।
কী বানাচ্ছ ইমন?
চাইনিজ লণ্ঠন।
চাইনিজ লণ্ঠন ব্যাপারটা কী?
মা, তোমাকে পরে বলি?
না এখন বলো।
চাইনিজ লণ্ঠন হলো এক ধরনের লণ্ঠন। লাল-নীল কাগজ দিয়ে বানাতে হয়। ভেতরে মোমবাতি থাকে। চিমনির মতো লাল-নীল কাগজ থাকে বলে রঙিন আলো হয়।
রেবেকা খুশি হয়ে লক্ষ করলেন, ছেলে এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। অনাগ্রহের সঙ্গে যে বলেছে তা না, আগ্রহের সঙ্গেই বলেছে। এটা খুবই ভালো লক্ষণ। স্কুলে ইমনকে ডিসটার্বড চাইল্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্কুল থেকে ঠিক করা এক সাইকিয়াট্রিস্ট ইমনকে দেখছেন। তিনি বারবার বলেছেন, কথা না-বলা রোগ থেকে ইমনকে বের করে আনতে হবে। তার সঙ্গে প্রচুর কথা বলতে হবে। কৌশলে তাকে দিয়ে কথা বলাতে হবে। তবে কখনোই বুঝতে দেয়া হবে না যে তাকে দিয়ে কথা বলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে তার ডিফেন্স মেকানিজম আরো কঠিন হয়ে যাবে।