আনিকার খুব বাচ্চার শখ। শখটা বাড়াবাড়ি রকমের বলেই তার ধারণা এই শখ কোনোদিন মিটবে না। এই পর্যন্ত তার একটি শখও মিটে নি। বড় বড় শখ তো অনেক পরের ব্যাপার, ছোটখাটো শখও মিটে নি। স্কুল থেকে একবার ঠিক করা হলো সবাই মিলে ময়নামতিতে যাবে। বেশি দূর তো না। ঢাকা থেকে দুঘণ্টা মাত্র লাগে। সে সত্তর টাকা চাদাও দিয়েছিল। যেদিন যাবার কথা, তার আগের রাতে উত্তেজনায় সে ঘুমাতে পর্যন্ত পারে নি। সারারাত ধরে উল্টাপাল্টা স্বপ্ন। যেমন সে কাপড় খুঁজে পাচ্ছে না। সকাল নটার মধ্যে স্কুলে উপস্থিত হবার কথা। নটা বাজতে মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। যখন অতি সাধারণ একটা জামা পরে বের হলো, তখন ঘড়িতে দশটা বেজে গেছে। সে স্কুলে যাবার জন্যে কোনো রিকশা পাচ্ছে না। কারণ সেদিনই রিকশা হরতাল দেয়া হয়েছে। গাড়ি ঠিকই চলছে, শুধু রিকশা নেই।
ময়নামতি যাওয়া শেষপর্যন্ত হয় নি। আনিকার বাবা সকালে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে হুঙ্কার দিলেন কিসের শিক্ষা সফর! এইসব ফাজলামি আমি জানি। শিক্ষা সফরের নামে যেটা হয়, তাকে বলে কুশিক্ষা সফর। কোথাও যেতে হবে না। ঘরে বসে টিভি দেখ।
সামান্য ময়নামতি যাবার শখ যেখানে মেটে না, সেখানে নিজের বাচ্চা কোলে নিয়ে আদর করার শখও তার মিটবে না। অথচ সে বাচ্চার নাম পর্যন্ত ঠিক করে রেখেছে। ডাক নাম। ভালো নাম রাখবে ছেলের বাবা। ডাক নাম হচ্ছে— ছেলে হলে ক। মেয়ে হলে আ। কেউ যখন ছেলেকে জিজ্ঞেস করবে, বাবা, তোমার নাম কী? ছেলে গাল ফুলিয়ে বলবে, আমার নাম ক?
তোমার নাম কি? শুধু ক?
হ্যাঁ।
এই নাম কে রেখেছে?
আমার মা রেখেছেন।
তোমার কি আরো ভাইবোন আছে?
আমরা তিন ভাইবোন। আমার আরো দুটা বোন আছে।
ওদের নাম কী?
একজনের নাম অ, আরেকজনের নাম আ।
আনিকা ঠিক করে রেখেছে তার তিনটা ছেলেমেয়ে হবে। তিন খুবই লাকি নাম্বার। ছেলেমেয়েরা তিনজন আর তারা দুজন। সব মিলিয়ে পাঁচজন। পাঁচও লাকি নাম্বার।
আচমকা ব্রেক কষে গাড়ি থামল। আনিকা চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। সে চোখ মেলল। ফাঁকা অচেনা রাস্তা। মনে হচ্ছে শহর থেকে তারা অনেকদূরে চলে এসেছে।
আনিকা বলল, আমরা কোথায়?
ড্রাইভার বলল, আশুলিয়ায়।
আনিকা বলল, সেটা আবার কোন জায়গা?
উত্তরার কাছে। ভালো ভালো চটপটির দোকান আছে। আপা, চটপটি খাবেন?
আনিকা বিরক্ত গলায় বলল, না। চটপটি খাব না। আমি চটপটি খাওয়া টাইপ মেয়ে না।
ড্রাইভার বলল, আপা, আপনারে একটা কথা বলি, কিছু মনে নিয়েন না।
আনিকা জবাব দিল না। চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার ধারণা জ্বর আরো বেড়েছে। তার উচিত বাসায় ফিরে সিটামল টাইপ কোনো ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়া। জ্বর কমাতে হবে। কাল সকাল নটা থেকে অফিস। অফিস কামাই দেয়া যাবে না। ক্যাজুয়েল লিভ পাওনা নেই। সেকশান অফিসার সিদ্দিক সাহেব তাকে ভালো চোখে দেখেন না। সারাক্ষণ চেষ্টা কীভাবে ভুল ধরবেন। কয়েক দিন আগে জ্যামে পড়ে অফিসে যেতে এক ঘণ্টা দেরি হয়েছে, সিদ্দিক সাহেব বলেছেন, আরে ম্যাডাম, আজ যে এত সকালে! লাঞ্চ করে এসেছেন তাই না? ভেরি গুড। নেক্সটটাইম শুধু লাঞ্চ করে আসবেন না, লাঞ্চের শেষে ঘুম দিয়ে আসবেন। দুপুরের ঘুম স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো।
ড্রাইভার বলল, আপা, আপনাদের বিয়েটা হয় নাই?
আনিকা বিরক্ত গলায় বলল, না।
ড্রাইভার বলল, পুরুষজাতের কোনো বিশ্বাস নাই। পুরুষজাত বিরাট হারামি। আমিও হারামি। আমার জীবনেও এইরকম ঘটনা আছে।
আনিকা বলল, আপনার জীবনের ঘটনা শুনতে চাচ্ছি না। আপনি গাড়ি চালান। গাড়ি চালানোর সময় এত কথা বলেন কেন?
আপা, গান দিব?
গান দিতে হবে না। আপনি বরং ফিরে চলুন। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।
লেকের ধারে নামবেন না?
আনিকা বলল, না। আমি লেক-ফেক দেখি না। আমার এত শখ নাই।
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরাল। আনিকা বাসায় ফিরছে— এটা ভাবতে তার নিজের কাছে খারাপ লাগছে। ঝগড়া খেচাখেচির মধ্যে পড়তে হবে। এর মধ্যে আবার সিনেমাও দেখা হবে। তার বাবা সিনেমায় গানের দৃশ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে তাল দেবেন। দেখে মনে হবে সঙ্গীতের বিরাট ওস্তাদ বসে আছেন। ওস্তাদ মতিয়ুর রহমান খান।
বাসায় না ফিরে অন্য কোথাও গেলে কেমন হয়? শওকতের বাসায় হঠাৎ উপস্থিত হয়ে তাকে চমকে দেয়া যায়। শওকত দরজা খুললেই সে বলবে, আমার খুব জ্বর। আজ আমি তোমার বাসায় থাকব। তুমি আমার সেবা করবে। মাথায় জলপট্টি দেবে। শওকত হকচকিয়ে বলবে, কী বলো পাগলের মতো! রাতে আমার এখানে থাকবে মানে?
আনিকা সহজ গলায় বলবে, স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে থাকবে, এতে সমস্যা কী?
শওকত আরো অবাক হয়ে বলবে, স্ত্রী মানে? তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে কখন হলো?
আনিকা বলবে, আজই তো বিয়ে হলো। মগবাজার কাজি অফিসে বিয়ে হলো। না-কি হয় নি? তাহলে বোধহয় জ্বরের ঘোরে এইসব মনে হচ্ছে। সরি। আমি চলে যাচ্ছি।
এরকম মজার নাটক আনিকার মাঝে-মাঝে করতে ইচ্ছা করে। অবশ্যি সে কখনোই করে না। সে ইচ্ছা-সুখ মেয়ে না। ইচ্ছা-সুখ হলো— যা করতে ইচ্ছা করে সেটা করে সুখ পাওয়া। আনিকা হলো ইচ্ছা-অসুখ মেয়ে। যা করতে ইচ্ছা করে তা না করতে পেরে অসুখী হওয়া।
শওকতের বাড়িতে যাবার প্রশ্নই আসে না। তার উচিত প্রাণপণে শওকতকে ভুলে থাকার চেষ্টা করা। সে এমন কিছু না যে তাকে ভেবে সারাক্ষণ কষ্ট পেতে হবে। মানুষটার বয়স হয়েছে পঞ্চাশ। বাংলাদেশের মানুষদের গড় আয়ু চল্লিশ। সেই হিসেবে সে দশ বছর বেশি বেঁচে ফেলেছে। তার ঘণ্টা বেজে গেছে। যেকোনো সময় ফুড়ৎ। প্রাণপাখি উড়ে যাবে। প্রাণপাখি নিয়ে সুন্দর একটা গানও আছে–