আনিকা বলল, তোমার বাসায় আমি কীভাবে উঠব? বাবার এক পয়সা। রোজগার নেই। পুরো সংসার চলছে আমার টাকায়।
শওকত বলল, তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে–বিয়ের পর তুমি তোমার বাসায় থাকবে। আমি আমার বাসায়।
আনিকা বলল, তুমি আমার বাসায় উঠে আসবে। আমি একটা আলাদা ঘর নিয়ে থাকি তুমি আমার ঘরে থাকবে। কিছুদিন পর মিতুর বিয়ে হয়ে যাবে। তখন মিতুর ঘরটায় তুমি তোমার ছবি আঁকার জিনিসপত্র রাখবে।
ঘরজামাই হবো?
আমরা মেয়েরা যদি ঘরবউ হতে পারি, তোমাদের ঘরজামাই হতে অসুবিধা কী?
কোনো অসুবিধা নেই।
সিগারেট তো শেষ হয়ে গেছে, হাতে নিয়ে বসে আছ কেন?
শওকত সিগারেট ফেলে দিতে দিতে বলল, তোমাকে একটা খবর দিতে চাচ্ছি।
কী খবর দেবে?
আমার ছেলে এসেছে ঢাকায়। সে কয়েক দিন আমার সঙ্গে থাকবে। আমার সঙ্গে জন্মদিন করবে।
ছেলে নিশ্চয়ই একা আসে নি। ছেলের মাও এসেছেন। তিনিও কি ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে তোমার সঙ্গে থাকবেন?
ছেলের মা অন্য একজনের স্ত্রী।
তাতে কী হয়েছে? পাকা রঙ এত সহজে যায় না। বাবা-মা দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছেলে জন্মদিনের কেক কাটবে। বাবা-মা একসঙ্গে সুর করে গাইবে— হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। তারপর তারা নিজেদের দিকে তাকিয়ে লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে হাসবে। সেই হাসির ছবি তোলা হবে।
ট্যাক্সি মগবাজার কাজি অফিসের সামনে থামল। ড্রাইভার জানাল সে ছয়শ টাকাতে রাজি আছে। শুধু বখশিশের পরিমাণ যেন বাড়িয়ে দেয়া হয়।
আনিকা বলল, বখশিশ নির্ভর করবে ভালো ব্যবহারের উপর। আপনি মাই ডিয়ার ব্যবহার করবেন, আমি আপনার বখশিশ বাড়িয়ে দেব। এখন আপনি যান, এককাপ চা খেয়ে আসুন। গাড়ি চালু রেখে যান। আপনার ঠাণ্ডা গাড়িতে বসে এই লোকের সঙ্গে কিছুক্ষণ ঝগড়া করব। আমাদের ঝগড়া আপনাকে শোনাতে চাই না।
শওকত গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিতে দিতে বলল, করো ঝগড়া করো।
আনিকা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, থাক ঝগড়া করব না। তোমার কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে আজ থেকে আমি একজন সেকেন্ডহ্যান্ড হাজবেন্ডের সন্ধানে বের হবো।
সেকেন্ডহ্যান্ড?
আনিকা বলল, অবশ্যই সেকেন্ডহ্যান্ড। আমার কপাল হলো সেকেন্ডহ্যান্ডের। আমার যখন সতেরো বছর বয়স, তখন বিয়ের যে প্রপোজল এলো সেই পাত্র সেকেন্ডহ্যান্ড। স্ত্রী মারা গেছে। বিরাট বড়লোক। তুমি চিন্তাই করতে পারবে না সেই সেকেন্ডহ্যান্ডওয়ালার সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্যে সবার সে কী চাপাচাপি! তারপর আরেকটা প্রপোজল এলো। ছেলে ইতালিতে থাকে। বিয়ে যখন প্রায় হয় হয় অবস্থা, তখন জানা গেল ছেলে কাগজপত্রের জন্যে জার্মান এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল। এক বছর তারা ছিল এক সঙ্গে। সেই পাত্রও বাবার পছন্দ। বাবা বললেন, প্রয়োজনে সে জার্মান বিয়ে করেছে। শখের বিয়ে তো না। সমস্যা কী? শেষমেষ সেকেন্ডহ্যান্ড আধবুড়ো তুমি উদয় হলে। আমি বুড়োর প্রেমে হাবুড়ুবু ও আমার জানরে, ও আমার পাখিরে অবস্থা।
শওকত বলল, আনিকা তোমার কি জ্বর না-কি?
আনিকা বলল, আমার কথাবার্তা কি জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার মতো শোনাচ্ছে?
চোখ লাল, এই জন্যে বলছি।
গায়ে হাত দিয়ে দেখ জ্বর কি-না। তোমার সঙ্গে আমি যে আচরণ করি, তা মোটামুটি বেশ্যামেয়েদের মতোই। বেশ্যামেয়ের গায়ে যে-কোনো সময় হাত দেয়া যায়।
শওকত বলল, তোমার জ্বর। বেশ ভালো জ্বর। বাসায় যাও। বাসায় গিয়ে শুয়ে থাক।
আনিকা বলল, আমি দুটা পর্যন্ত ক্যাব ভাড়া করেছি। ছটা পর্যন্ত ক্যাব নিয়ে ঘুরব। একা একা ঘুরব।
একা একা?
দোকা কোথায় পাব? একা একাই ঘুরব। বাসায় আমি ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারি না। মাঝে মাঝে বাইরে বের হই নিঃশ্বাস নেবার জন্যে। এখন তুমি যদি কিছু মনে না কর, তোমাকে একটা অনুরোধ করব।
করো অনুরোধ।
গাড়ি থেকে নেমে যাও। আমি চাচ্ছি না তুমি আমার সঙ্গে থাক।
ছটা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে থাকতে আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি জানো আমি এমন কোনো ব্যস্ত মানুষ না।
আনিকা বলল, তোমার সমস্যা না থাকলেও আমার আছে। প্লিজ নেমে যাও।
শওকত গাড়ি থেকে নেমে গেল।
ড্রাইভার বলল, আপা কোথায় যাব?
আনিকা বলল, আমার শরীরটা প্রচণ্ড খারাপ। আমাকে বারবার প্রশ্ন করে বিরক্ত করবেন না। আপনাকে তো বলেছি সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত আমাকে নিয়ে ঘুরবেন।
শহরের বাইরে যাব আপা?
বাইরে মানে কোথায়?
গাজীপুর শালবন। কিংবা বিশ্বরোড ধরে কুমিল্লার দিকে যেতে পারি।
শহরের ভেতর ঘুরতে আপনার অসুবিধা কী?
কোনো অসুবিধা নেই। শহরের ভেতরে যানজট। গাড়ি নিয়ে বসে থাকতে RI
আপনার যেখানে ইচ্ছা যান। ছটার সময় বাসায় পৌছলেই হবে। আমার বাসা কলাবাগানে।
আনিকা চোখ বন্ধ করল। তার শরীর হঠাৎ করেই বেশ খারাপ করছে। বুকের ভেতর ধ্বক ধ্বক শব্দ। নিঃশ্বাসে কষ্ট। নিঃশ্বাসের এই কষ্ট যখন হয়, তখন খুব পানির তৃষ্ণা হয় অথচ পানি খেতে গেলে বমির মতো আসে। আনিকার ধারণা তার বড় ধরনের কোনো হার্টের অসুখ হয়েছে। মেয়েদের জন্যে হার্টের অসুখ খুব খারাপ। হার্ট দুর্বল মেয়েরা বাচ্চা নিতে পারে না। আনিকার এক বান্ধবীর (শারমিন) হার্টের অসুখ ছিল। ডাক্তাররা তাকে বাচ্চা নিতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। শারমিন এখন অস্ট্রেলিয়াতে। সেখানে তার বাচ্চা হয়েছে কি-না কে জানে! হবার কথা। অস্ট্রেলিয়ায় বড় বড় ডাক্তার আছে। তারা নিশ্চয়ই শারমিনের হার্ট ঠিক করে ফেলেছে।