জি।
আনিকার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
জি দেখা হয়েছে। ও আমাকে নিয়ে কোথায় যেন যাবে— এই জন্যে খবর দিয়েছে। মনে হয় তৈরি হচ্ছে।
মতিয়ুর রহমান বললেন, মেয়েদের তৈরি হওয়া তো সহজ ব্যাপার না। ঘণ্টা দুই লাগবে। এই ফাঁকে এসো একটা ছবি দেখে ফেলি। উত্তম-সুচিত্রার ছবি। আগে দেখছ নিশ্চয়ই। সাগরিকা।
চাচা, ছবি দেখব না।
কিছুক্ষণ দেখ। একা ছবি দেখে মজা নাই। আনিকার সাজ শেষ করে বের হতে দেরি আছে। আমার মেয়েদের আমি চিনি না! এদেরকে হাড় মাংসে চিনি।
শওকত ছবি দেখতে বসল। মতিয়ুর রহমান ছবি দেখতে দেখতে ক্রমাগত কথা বলতে থাকলেন।
মিতুর ঘটনা শুনেছ?
জি-না।
অতি হারামি মেয়ে। বান্ধবীর জন্মদিন। রাতে বান্ধবীর সঙ্গে না থাকলে বান্ধবী না-কি কাঁদতে কাঁদতে মরেই যাবে। তারপর কী হয়েছে শোন। কাজী নজরুলের কবিতা পড়বি পর মালীর ঘাড়ে সে ছিল গাছের আড়ে। সেই বান্ধবী সকালে বাসায় উপস্থিত। আমি বললাম, মা, জন্মদিন কেমন হলো? সেই মেয়ে অবাক হয়ে বলল, কিসের জন্মদিন চাচা? এইদিকে মিতু আবার চোখ ইশারা করতে করতে বলছে— তোর জন্মদিনের কথা হচ্ছে। ঐ যে কালরাত সবাই মিলে তোর বাসায় সারারাত হৈচৈ করলাম। মিতুর বান্ধবী গেল আরো হকচকিয়ে। সে একবার আমার দিকে তাকায়, একবার মিতুর দিকে তাকায়। বুঝেছ শওকত, আজকালকার ছেলেমেয়েরা কোনো কিছুই ঠিকমতো পারে না। একটা মিথ্যা পর্যন্ত গুছিয়ে বলতে পারে না। মিতুকে প্রিলিমিনারি একটা ক্যাচা দিয়েছি। রাতে আরো একডোজ ওষুধ পড়বে। তার খবর আছে।
উত্তম-সুচত্রার সাগরিক অনেকখানি দেখে শওকত বের হলো। আনিকা মোটামুটি কঠিন টাইপ সাজ করেছে। তাকে দেখে শওকতের মায়া লাগছে। সাজলে এই মেয়েটাকে ভালো লাগে না। কোনোরকম সাজসজ্জা ছাড়া সে যখন সাধারণভাবে থাকে, তখন তার চেহারায় মিষ্টি মায়া ভাব থাকে। সাজলে সেটা থাকে না। চেহারা রুক্ষ হয়ে যায়। বয়স্ক মা-খালা ধরনের মহিলা মনে হয়। আনিকার এমন কিছু বয়স হয় নি। ত্রিশ বছর অবশ্যি হয়ে গেছে। একটি কুমারী মেয়ের ত্রিশ বছর তেমন বয়স না। অথচ এই মেয়েটাকে দেখে মনে হয় দ্রুত তার বয়স বাড়ছে। মাথার চুল পড়তে শুরু করেছে।
শওকত বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আনিকা বলল, আমার সাজসজ্জা দেখে বুঝতে পারছ না কোথায় যাচ্ছি?
না, বুঝতে পারছি না।
আমার সাজ কেমন হয়েছে?
খারাপ না— একটু শুধু কটকটা হয়েছে।
কটকটা মানে কী?
হাওয়াই মিঠাই টাইপ।
আনিকা আহত গলায় বলল, আমি যত সুন্দর করেই সাজি না কেন–তুমি সবসময় বলো, কটকটা। তুমি কি চাও আমি বিধবাদের কাপড় পরি? সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ?
তোমার যা পছন্দ তাই পরবে।
আনিকা বলল, আজ রিকশায় উঠব না। এসি আছে এমন কোনো ইয়োলো ক্যাব নাও।
শওকত বলল, আমরা যাচ্ছি কোথায়?
আনিকা বলল, মগবাজারে যাচ্ছি।
কোনো বিয়ের দাওয়াত?
আনিকা কঠিন গলায় বলল, বিয়ের দাওয়াত-ফাওয়াত না। আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। মগবাজার কাজি অফিসে যাব।
শওকত বলল, ঠাট্টা করছ?
আনিকা বলল, ঠাট্টা করব কেন? তুমি তো জানো আমি ঠাট্টা করার মেয়ে। তোমার পাল্লায় পড়ে আমি অনেক দিন ঘুরেছি। আমার আর ভালো লাগছে। হয় তুমি আজকে আমাকে বিয়ে করবে; আর যদি তা না হয়, বিয়ে করতে কখনো বলব না। আমার নিজেকে সিন্দাবাদের ভূত বলে মনে হয়। তোমার ঘাড়ে চেপে আছি। তুমি যতই ফেলতে চাচ্ছ, আমি ততই কাঁচকি মেরে বসছি।
শওকত হাসল। আনিকা বলল, এভাবে হাসবে না। আমি হাসির কোনো কথা বলছি না। দাঁড়িয়ে আছ কেন? ট্যাক্সি আন। এসি আছে এমন গাড়ি আনবে। আজ কেন জানি আমার খুব গরম লাগছে। হাঁসফাঁস লাগছে।
ট্যাক্সিতে উঠে আনিকা সত্যি সত্যি ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল, মগবাজার যাবেন? মগবাজার কাজি অফিস। চিনেন না?
ট্যাক্সিওয়ালা বলল, চিনি।
আনিকা বলল, আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা আপনার ট্যাক্সিটা ভাড়া করতে চাই। ঘণ্টায় এত রেট এ ধরনের ফালতু অ্যারেঞ্জমেন্টে আমি যাব না। সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত থাকবেন। কত নিবেন বলেন। প্যাকেজ ডিল।
এক হাজার টাকা দেন।
পাঁচশ পাবেন। চিন্তা করে দেখেন। বখশিশ আলাদা দেব। এক্ষুণি জবাব দিতে হবে না। মগবাজার কাজি অফিসে যেতে যেতে চিন্তা করেন।
শওকত বলল, আমরা কি সত্যি সত্যি কাজি অফিসে যাচ্ছি?
আনিকা ক্লান্ত গলায় বলল,। তোমার কি অসুবিধা আছে? বিয়ের কথা তো অনেক দিন থেকেই বলছ। সামনের বছর বিয়ে। এই শীতে না, পরের শীতে। এই করে করে সাত বছর পার করেছ। আর কত?
শওকত বলল, একটা সিগারেট ধরাই?
ধরাও। ড্রাইভার সাহেব গাড়ির কাচ নামিয়ে দিন। আর আপনি চিন্তাভাবনা করছেন তো? আমি আরো একশ বাড়িয়ে দিলাম। ছয়শ।
শওকত সিগারেট টানছে। তারা কাজি অফিসে যাচ্ছে এই নিয়ে সে খুব যে চিন্তিত তা না। এক্ষুণি বিয়ে করতে হবে— এরকম একটা ঝোকের ভেতর দিয়ে আনিকা প্রায়ই যায়। ঝোক কেটেও যায়। আজকেও নিশ্চয়ই সে-রকম কিছু হবে। তবে ট্যাক্সি নিয়ে কাজি অফিসের দিকে রওনা দেয়াটা বাড়াবাড়ি। একে ঝোঁক বলা ঠিক হচ্ছে না।
আনিকা বলল, তুমি কথা বলছ না কেন?
চিন্তা করছি।
আও বিয়ে করার ব্যাপারে তোমার আপত্তি আছে? আজ শুভদিন। শুক্রবার। অক্টোবরের তিন তারিখ। ১৩ আশ্বিন।
শওকত বলল, বিয়ের মতো বড় ব্যাপারে প্রিপারেশন লাগবে না?
আশিক। বলল, তুমি তো সাত বছর ধরেই প্রিপারেশন নিচ্ছ। আরো প্রিপারেশন লাগবে?
শওকত বলল, বিয়ের পর তুমি কি আমার এখানে উঠবে?