আমি আমার বাবাকে তিনটা কার্ড পাঠিয়েছি। তিনটা কার্ডের ছবি আমি নিজে এঁকেছি। একটাতে ছিল ক্রিসমাস ট্রি। আরেকটা ছবিতে আমি মাছ মারতে লেক ইওনিতে গিয়েছি। অন্য কার্ডটা শুধু ডিজাইন। কার্ডগুলো পাঠাতে আমার খুবই লজ্জা লাগছিল। কারণ, আমার বাবা কত ভালো ছবি আঁকেন। আর আমি তো ছবি আঁকতেই পারি না। আমি যখন রঙ দেই, তখন একটা রঙের সঙ্গে আরেকটা রঙ মিশে কেমন যেন হয়ে যায়। যদি কখনো বাবার সঙ্গে আমার দেখা হয়, তাহলে আমি তার কাছ থেকে ছবি আঁকা শিখব।
আমার আঁকা তিনটা কার্ডের কোনোটাই শেষপর্যন্ত বাবাকে পাঠানো হয় নি, কারণ আমার মা বাবার ঠিকানা জানতেন না। মার কোনো দোষ নেই, কারণ বাবার স্বভাব হচ্ছে দুদিন পর পর বাড়ি বদলানো। বড় বড় শিল্পীরা এরকমই হয়। ভ্যানগ নামের শিল্পীর কোনো বাড়ি-ঘরই ছিল না। আমাদের আর্ট টিচার মিস সুরেনসন বলেছেন— ভ্যানগগ তার প্রেমিকাকে নিজের কান কেটে উপহার দিয়েছিলেন। আমি মনে মনে খুব হেসেছি। কাটা কান কি কাউকে উপহার হিসেবে দেয়া যায়? আমি শব্দ করে হাসি নি কারণ শব্দ করে হাসলে মিস সুরেনসন রাগ করেন।
রাগ করলেও আমাদের সবার উচিত শব্দ করে হাসা এবং শব্দ করে কাদা। কারণ তাতে আমাদের লাংস পরিষ্কার থাকে। এই কথাটা আমাদেরকে বলেছেন আমাদের গেম টিচার। আমি যদিও কোনো গেম পারি না, তারপরেও আমি গেম টিচারকে খুব পছন্দ করি। তাকে সবাই ডাকে কনি। কিন্তু তার নাম রিচার্ড বে হাফ। আমি গেম টিচারকে আমার বাবার কথা বলেছি। তিনি বলেছেন–তোমার বাবা তো একজন অতি ভালোমানুষ। তার সঙ্গে আমি দেখা করতে
দেখা করা সম্ভব না। কারণ বাবা তো আর আমেরিকায় থাকেন না। বাবা যদি আমেরিকায় থাকতেন তাহলে আমি অবশ্যই বাবার সঙ্গে তাঁর দেখা করিয়ে দিতাম। বাবাকে বলতাম, তুমি মিস্টার কনির একটা পোট্রেট এঁকে দাও। পোট্রেট করার সময় তার গালের কাটা দাগটা মুছে দিও। এই কাটা দাগটা উনি পছন্দ করেন না।
মিস্টার কনি আমাকে বলেছেন বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা নিয়ে কখনো মন খারাপ করতে নেই। তুমি দূর থেকে তোমার বাবাকে ভালোবাসবে। তোমার বাবাও দূর থেকে তোমাকে ভালোবাসবেন। যখন তোমাদের দেখা হবে তখন দেখবে তোমার এবং তোমার বাবার ভালোবাসার মধ্যে রেসলিং শুরু হবে। সব রেসলিং-এ একজন হারে একজন জিতে। এই রেসলিং-এ দুজনই জিতবে।
মিস্টার কনি এত মজার মজার কথা বলেন! মজা করে কথা বললেও তিনি আসলে খুবই জ্ঞানী।
শওকত তার ছেলের লেখা রচনা অতি দ্রুত একবার শেষ করে দ্বিতীয়বার পড়তে শুরু করল। প্রথমবার পড়তে কোনো সমস্যা হয় নি, দ্বিতীয়বার পড়তে খুব কষ্ট হলো। এক একটা লাইন পড়ে, চিঠি ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে।
কোনো পরিবারে একজন কেউ কানে কম শুনলে
কোনো পরিবারে একজন কেউ কানে কম শুনলে বাকি সবাই জোরে কথা বলে। আনিকাদের বাড়ির কেউই কানে কম শোনে না, তারপরেও সবাই জোরে কথা বলে। মনে হয় এ বাড়ির লোকজন সবাই সারাক্ষণ ঝগড়া করছে।
শওকত আনিকার কাছে এসেছে। সে বসেছে বারান্দায় পেতে রাখা চৌকিতে। কলাবাগানে মোটামুটি আধুনিক একটি ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দায় তোষকবিহীন চৌকি পেতে রাখা সাহসের ব্যাপার। আনিকাদের সে সাহস আছে। চৌকিটা বাড়তি বিছানা হিসেবে কাজ করে। হঠাৎ কোনো অতিথি এসে পড়লে চৌকিতে ঘুমুতে দেয়া হয়। পরিবারের কোনো সদস্য রাগ করলে এই চৌকিতে ঝিম ধরে বসে থাকে। আনিকা হাসতে হাসতে বলেছিল, আমাদের এই চৌকিটার নাম রাগ-চৌকি। তুমি যদি কখনো রাত দুটা-তিনটার সময় আসো, তাহলে দেখবে কেউ না কেউ রাগ করে চৌকিতে বসে আছে। শওকত বলেছিল, দুজন যদি একসঙ্গে রাগ করে, তখন কী হয়? দুজন পাশাপাশি বসে থাকে?
আনিকা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তোমার কি ধারণা বাড়িতে আমরা সব সময় ঝগড়া করি? আমাদের সম্পর্কে তোমার এত খারাপ ধারণা?
তাদের সম্পর্কে শওকতের ধারণা খুব যে উঁচু তা না। আজ শুক্রবার ছুটির দিন। ছুটির দিনে সবার মন-মেজাজ ফুরফুরে থাকার কথা। অথচ শওকত আধঘণ্টা বসে থেকে চড়-থাপ্পড়ের শব্দ শুনেছে। কান্নার শব্দ শুনেছে। আনিকার বাবার গর্জন কিছুক্ষণ পরপরই শোনা যাচ্ছে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলব! আমি অবশ্যই তোকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব! যাকে পুঁতে ফেলার কথা বলা হচ্ছে, তার নাম মিতু। আনিকার ছোটবোন। মিতু এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে। গত পরশু রাতে সে বাসায় ফিরে নি। বান্ধবীর জন্মদিনের কথা বলে বান্ধবীর বাসায় থেকে গেছে। পরদিন জানা গেছে বান্ধবীর জন্মদিন ছিল না। বান্ধবীর বাসায় মিতু থাকে নি।
অপরাধ অবশ্যই গুরুতর। শওকত অবাক হয়ে দেখল, কিছুক্ষণের মধ্যে সব স্বাভাবিক। আনিকার বাবা মতিয়ুর রহমান টিভি ছেড়েছেন। সেখানে তারা চ্যানেলে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখাচ্ছে। তিনি আগ্রহ নিয়ে স্ত্রীকে ছবি দেখার জন্যে ডাকছেন। এই ভদ্রলোক একা কোনো ছবি দেখতে পারেন না। ছবি দেখার সময় তার আশেপাশে সবসময় কাউকে না কাউকে লাগে। এক সময় দর্শকের সন্ধানে তিনি বারান্দায় উঁকি দিয়ে শওকতকে দেখে বললেন, তুমি কখন এসেছ?
শওকত উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, বেশিক্ষণ হয় নি।
তুমি চুপি চুপি বারান্দায় এসে বসে থাকবে এটা কেমন কথা! তোমাকে চা-টা দিয়েছে?