জামাল বলল, আছে।
আনিকা বলল, আমি ঠিকানা দিচ্ছি, ড্রাইভারকে পাঠাও আমার বড়খালা আর ছোটখালাকে নিয়ে আসবে।
জামাল বলল, আমি সঙ্গে যাই? উনারা মুরুব্বি মানুষ। ড্রাইভার দিয়ে উনাদের আনানো ঠিক হবে না।
আনিকা বলল, তোমার যেতে হবে না। তোমার এখানে কাজ আছে। ড্রাইভারকে কিছু টাকা দিয়ে দাও, এক লিটারের ছয়টা কোক আনবে, তিনটা সেভেন আপ আনবে। ঠাণ্ডা হয় যেন।
আর কিছু?
আর কিছু লাগবে না। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে আস। ঘামে মুখ তেলতেলা হয়ে আছে।
জামাল শওকতের দিকে তাকিয়ে বলল, ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়ে বাকি গল্পটা বলব। আমাকে শুধু ধরিয়ে দিতে হবে। যেখানে শেষ করেছি, সেখান থেকে শুরু করব। কোথায় শেষ করেছি মনে আছে তো?
শওকত বলল, মনে আছে। একসময় আপনার কাছে মনে হলো পানিতে অক্সিজেন কমে আসছে। কারণ মাছের পোনাগুলি ঘনঘন পানিতে ভেসে উঠছে।
জামাল বলল, এটা সমস্যার মাত্র শুরু। সবটা না শুনলে বুঝবেন না। এক্ষুণি আসছি।
জামাল অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হলো। শওকত বলল, তোমরা এত স্বাভাবিকভাবে কথা বলছ দেখে ভালো লাগছে।
আনিকা বলল, ও একটু বোকা। এত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলাটা যে খুবই অস্বাভাবিক বোকা বলেই সে তা ধরতে পারছে না।
তুমি অতি বুদ্ধিমতী হয়েও কিন্তু স্বাভাবিক আচরণ করছ।
আনিকা বলল, মেয়ে হলো পানির মতো। বর্ণহীন। যে পাত্রে তাকে রাখা হবে সে সেই পাত্রের রঙ তার গায়ে মাখবে। বোকার সঙ্গে যে মেয়ের বিয়ে হবে, তার হাভভাব হয়ে যাবে বোকার মতো। আর সেটাই ভালো।
তোমার আনন্দিত মুখ দেখতে ভালো লাগছে।
আনিকা বলল, ভালো লাগলেই ভালো। কিছুক্ষণ আগে আপনার পুত্রের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাকে আমি আমার বিয়েতে দাওয়াত দিয়েছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে আসছে। তার মা গাড়ি দিয়ে তাকে পাঠাচ্ছেন।
শওকত বিস্মিত হয়ে বলল, তাই না-কি!
আনিকা বলল, আমিও খুব অবাক হয়েছি। আপনার ছেলে বলেছে তাকে দশ-পনেরো মিনিট সময় দিলেই সে মুক্তার মালা বানিয়ে দেবে। আলপিন গরম করে মুক্তোর গায়ে ফুটো করতে হবে। আপনি চা খাবেন?
শওকত বলল, না।
আমার খুব চা খেতে ইচ্ছা করছে। আপনি যদি খান, আমি আপনার সঙ্গে এক কাপ চা খাব। বাকি জীবনে আর হয়তো আপনার সঙ্গে চা খাওয়া হবে না। আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। পড়ে থাকব গ্রামে।
চাকরি? তোমার চাকরির কী হবে?
আনিকা বলল, চাকরি করব না। স্বামীর খামার দেখব। হাঁস-মুরগি পালব। স্বামীর সেবা করব। ভাগ্য ভালো হলে ইমনের মতো সুন্দর বুদ্ধিমান দুএকটা ছেলেমেয়ে হয়তো আমাদের হবে। তাদেরকে আদর-মমতা-ভালোবাসায় বড় করব। আপনার কি মনে হয় আমি পারব না?
শওকত বলল, অবশ্যই পারবে। তোমার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি পারবে।
থ্যাংক য়্যু। আমি পারতে চাই।
ইমনের মুক্তার মালা তৈরি হয়েছে। সময় বেশি লেগেছে, কারণ পুরনো মুক্তা ফেলে দিয়ে মোম গলিয়ে নতুন মুক্তা বানানো হয়েছে। কাজটা ইমন একা করে নি, শওকত তাকে সাহায্য করেছে। যে গভীর মনোযোগের সঙ্গে দুজন কাজ করেছে সেই মনোযোগ দেখার মতো। শেষপর্যায়ে জামাল এসে তাদের সঙ্গে যুক্ত হলো। দেখা গেল মুক্তা বানানোর ব্যাপারে তার স্বাভাবিক দক্ষতা আছে। হাত না কাপিয়ে সে গলন্ত মোম ফেলতে পারে। একটা মুক্তা আরেকটা মুক্তার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে না।
মুক্তার মালা গলায় দিয়ে আনিকা ইমনকে কোলে নিয়ে গালে চুমু দিল। তারপর নিচু হয়ে শওকতকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। তখনো ইমন তার কোলে।
চুমু খাওয়ায় ইমন যতটুকু লজ্জা পেয়েছিল, সালাম করায় শওকত ঠিক ততটুকুই লজ্জা পেল।
আনিকা বলল, শওকত ভাই! আমি আপনার ছেলেকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াই। আপনি আমাদের দুজনের একটা পোট্রেট করে দিন। কাগজ আর গাদাখানিক পেন্সিল আমি আনিয়ে রেখেছি। আজ সারা দুপুর বসে বসে পেন্সিল কেটেছি। ব্লেড দিয়ে পেন্সিল কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলেছি। এই দেখেন কাটা আঙুল।
শওকত বলল, ছবি আঁকা ভুলে গেছি আনিকা।
চেষ্টা করে দেখুন। তাকান আমাদের দিকে। আমাদের দেখতে সুন্দর লাগছে না?
শওকত তাকাল। সে অবাক হয়ে দেখল, আনিকার চোখ জলে টলমল করছে। শুধু তাই না, ইমনেরও চোখভর্তি জল। আহারে কী সুন্দর কম্পােজিশান। কী সুন্দর! কী সুন্দর! চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লেই এই কম্পােজিশান নষ্ট হয়ে যাবে। শওকতকে যা করতে হবে তা হচ্ছে এই দৃশ্যটা মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাদের দিকে আর তাকানো যাবে না। পোট্রেট করতে হবে স্মৃতি থেকে।
শওকত হাত বাড়িয়ে বলল, দেখি কাগজ দেখি।
অতি দ্রুত সে পেন্সিল টানছে। কোনোদিকেই তাকাচ্ছে না। অন্যদিকে তাকানোর সময় তার নেই। অনেক অনেক দিন পর তার মাথায় পুরনো ঝড় উঠেছে। কী ভয়ঙ্কর অথচ কী মধুর সেই ঝড়! ইমন এক গাদা পেন্সিল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার হাতের পেন্সিল ভেঙে যেতেই সে পেন্সিল এগিয়ে দিচ্ছে। তার খুব ইচ্ছা করছে পোট্রেটটা কেমন হচ্ছে উঁকি দিয়ে দেখতে। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তবে না দেখেও ইমন বুঝতে পারছে বাবা অসাধারণ একটা পোট্রেট আঁকছেন।
নিমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই শওকতকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের চোখে কৌতুহল এবং বিস্ময়। একটু দূরে আনিকা দাঁড়িয়ে। সে ক্রমাগত কাদছে। আনিকার পাশে জামাল ব্রিত মুখে দাঁড়িয়ে। আনিকা তার দিকে তাকিয়ে বলল, এইভাবে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমি কাঁদছি দেখছ না? আমার হাত ধর। না-কি হাত ধরতে লজ্জা লাগছে?