মিতুর স্বামী ক্যামেরা হাতে ঘুরছে। প্রচুর ছবি তোলা হচ্ছে। বাবা-মার মাঝখানে আনিকা। বরের সঙ্গে আনিকা। বর আনিকাকে শরবত খাওয়াচ্ছে তার ছবি। কাজি সাহেব দোয়া পড়ছেন তার ছবি। সবাইকে খেজুর দেয়া হচ্ছে তার ছবি। এক পর্যায়ে আনিকা বলল, শওকত ভাইয়ের সঙ্গে আমি একটা ছবি তুলব। দীর্ঘদিন পর শওকতকে সে শওকত না ডেকে শওকত ভাই ডাকল।
ছবি তোলা হলো। আনিকা বলল, শওকত ভাই, আমি যে সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফেলব তা বোধহয় ভাবেন নি?
শওকত বলল, না ভাবি নি। আজ যে তোমাদের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান তাও ভাবি নি।
অবাক হন নি?
হ্যাঁ হয়েছি।
আমি যখন খুব জরুরি খবর পাঠালাম, ইমনের বানানো মোমের মুক্তা নিয়ে চলে আসুন, তখনো নিশ্চয়ই কিছু বুঝতে পারেন নি?
বুঝতে পারি নি।
আনিকা বলল, আমি ভেবে রেখেছিলাম বিয়ে যখন পড়ানো হবে, তখন আমার গলায় মুক্তার মালা থাকবে। সমস্যা হলো, এই মুক্তাগুলি দিয়ে মালা গাঁথা যায় না। সুই ঢুকাতে গেলেই মুক্তা ভেঙে যায়। আপনার ছেলের কাছ থেকে জেনে নেবেন তো কী করে মালা গাঁথা যায়? সে কি দেশে আছে, না চলে। গেছে?
দেশে আছে। আগামীকাল রাত তিনটায় চলে যাবে।
তার টেলিফোন নাম্বার দিন। আমি তার সঙ্গে কথা বলব। তার সঙ্গে আমার একটা চুক্তি হয়েছিল। আমি যখন বিয়ে করব, আমি তাকে জানাব। সে যখন বিয়ে করবে, সে আমাকে জানাবে। আমরা দুজন দুজনের বিয়েতে উপস্থিত থাকব।
শওকত টেলিফোন নাম্বার দিল। আনিকা বলল, আপনি আমার বরের সঙ্গে কথা বলুন। আমি আপনার ছেলের সঙ্গে কথা বলব। আরেকটা কথা, আপনি কিন্তু না খেয়ে যাবেন না। আজকের রান্না আমি নিজে বেঁধেছি। জীবনে কখনো শুনেছেন কোনো মেয়ে তার নিজের বিয়ের রান্না নিজে বেঁধেছে?
না, শুনি নি।
এখন বুঝতে পারছেন তো আমি খুব অন্যরকম একটা মেয়ে?
বুঝতে পারছি।
সিন্দাবাদের ভূত ঘাড় থেকে নেমে গেছে। নিজেকে হালকা লাগছে না শওকত ভাই?
শওকত কিছু বলল না। আনিকা বলল, সবার সঙ্গে বসে থাকতে যদি আপনার অস্বস্তি লাগে, আপনি মিতুর ঘরে বসতে পারেন। মিতুর ঘর খালি আছে। কিংবা আপনি রাগ-চৌকিতেও বসতে পারেন। রাগ-চৌকিও খালি।
শওকত বলল, তুমি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। আমি ভালো আছি।
আনিকা বলল, ভালো থাকলেই ভালো। আজ একটা শুভদিন। আমি চাই শুভদিনে সবাই ভালো থাকুক।
ঘরোয়াভাবে বিয়ে। বরের কয়েকজন আত্মীয়স্বজন এসেছে। মিতু তার শ্বশুর এবং স্বামীকে নিয়ে এসেছে। বাইরের লোক বলতে শওকত।
শওকত বারান্দায় রাগ-চৌকিতে বসতে গিয়ে দেখে, মধ্যবয়স্ক এক লোক ফুটফুটে একটা মেয়ে নিয়ে রাগ-চৌকিতে বসে আছে। সেই লোক শওকতকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলল, স্যার ভালো আছেন?
শওকত বিস্মিত হয়ে বলল, ভালো আছি। আপনাকে কিন্তু চিনতে পারছি না।
আমার নাম আকবর। এটা আমার মেয়ে, নাম উজ্জলা। এখন কি চিনেছেন?
না।
আকবর গলা নামিয়ে বলল, আপনাকে আর আপাকে মগবাজার কাজি অফিসে নিয়ে গিয়েছিলাম। আপার সঙ্গে আপনার বিয়ের কথা ছিল।
ও আচ্ছা। আপনি সেই লোক?
আকবর বলল, আপা আমাকে খুবই স্নেহ করেন। হঠাৎ উনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। উনি আমাকে মোবাইলে খবর দিলেন। উনার কাছে আমার মোবাইল নাম্বার আছে।
ভালো তো।
আপনার কিছু লাগলে আমাকে বলবেন। ব্যবস্থা করব। আমি এই বাড়ির ঘরের মানুষের মতো। চা খাবেন?
আমি কিছু খাব না। থ্যাংক য়্যু।
আপনি বিশ্রাম করেন, আমি কাজ-কর্মের অবস্থা দেখি। আপার কোনো ভাই না থাকায় সমস্যা হয়েছে। বিয়ে-শাদির মতো অনুষ্ঠানে কাজকর্ম করতে পারে এমন পুরুষমানুষ দরকার।
আকবর তার কন্যাকে নিয়ে চলে যাবার পর পর আনিকার বর জামাল এসে পাশে বসল। শওকত বলল, একদিন আমি আপনার খামারবাড়ি দেখতে যাব।
জামাল বলল, অবশ্যই যাবেন। রাতে থাকবেন। শহর থেকে যে সব গেস্টরা যান, তাদের জন্যে রেস্টহাউসের মতো বানিয়েছি। তিনটা ঘর আছে। একটায় এসি লাগানোর ব্যবস্থা রাখা আছে। এখনো লাগানো হয় নি।
গণ্ডগ্রামে এসি দেয়া ঘর! ভালো তো।
আপনার দেখতে ভালো লাগবে। গেস্ট হাউসের সামনের ফুলের বাগান সম্পূর্ণ আমার নিজের হাতে করা। মালী অবশ্য আছে।
জামাল ছেলেটাকে শওকতের পছন্দ হলো। তার চোখে স্বপ্ন আছে। জীবনের লক্ষ্য স্থির করে সে এগোচ্ছে। এই ধরনের ছেলেরা সহজে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় atti
শওকত ভাই, আপনার কথা আমি আমার স্ত্রীর কাছে অনেক শুনেছি। একদিন যদি গ্রামে আসেন খুব খুশি হবো।
শওকত হাসল। পনেরো মিনিট হয় নি বিয়ে হয়েছে। এখনই সে এমনভাবে বলছে আমার স্ত্রী যে শুনতে ভালো লাগছে। এত অহঙ্কার নিয়ে আমার স্ত্রী বোধহয় এর আগে কেউ বলে নি।
ছেলেটার চেহারা ভালো। গায়ের রঙও নিশ্চয়ই ফর্সা ছিল। রোদে পুড়ে সেই রঙ তামাটে হয়েছে। ইউরোপিয়ানরা এই রঙ খুব পছন্দ করে। ছেলেটা এখন কথা বেশি বলছে, তবে সে খুব বেশি কথা বলে এমন মনে হচ্ছে না। বিয়ের উত্তেজনায় জড়তা কেটে গেছে। মানসিক উত্তেজনা একেক মানুষকে একেকভাবে বদলায়।
শওকত তাকিয়ে আছে। জামাল চিটাগাং-এর হলদিয়া নদীর রুইপোনা কীভাবে ঢাকায় এনেছে তার গল্প করছে। গল্প বলার ভঙ্গি থেকে সবারই মনে হবে, এটা কোনো দুর্দান্ত ডিটেকটিভ গল্প। মাছের পোনা আনা হচ্ছে না, এনরিচড ইউরেনিয়াম আনা হচ্ছে। পদে পদে ক্লাইমেক্স!
গল্প যেখানে এন্ড ক্লাইমেক্সের দিকে যাচ্ছে সেখানে আনিকা ঢুকল। জামালের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, এই, তোমার সঙ্গে একটা মাইক্রোবাস আছে না?