রেস্টুরেন্টের রান্না?
হ্যাঁ।
খাওয়া-দাওয়া কি সব হোটেল থেকে আসে?
একবেলা ঘরে রান্না হয়।
একবেলাটা কখন?
রাতে।
কে রাঁধে?
আমি নিজেই রাঁধি। ভাত ডিম ভাজি ডাল। সিম্পল ফুড।
বাসায় কাজের কোনো লোক নেই?
একজন ছিল। মায়ের অসুখ বলে দেশে গিয়েছিল, আর ফেরে নি।
রেবেকা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি চায়ের কথা বলে আসি। চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে?
না।
তোমাকে অতি ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন যে করলাম, তার পেছনে কারণ আছে। তোমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমার এখন আগ্রহ দেখানোর কিছু নেই।
কারণটা কী?
আমি দেশে এসেছি পনের দিনের জন্য। সঙ্গে করে ইমনকে নিয়ে এসেছি। সে তার এবারের জন্মদিন তোমার সঙ্গে করতে চায়। আমি ঠিক করেছি চারপাঁচদিন একনাগাড়ে তাকে তোমার সঙ্গে থাকতে দেব।
আমার কথা কি তার মনে আছে?
মনে থাকবে না কেন? তোমার সঙ্গে যখন আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, তখন ইমনের বয়স পাঁচ বছর তিন মাস। চার বছর থেকেই শিশুদের সব স্মৃতি থাকে।
ইমন কোথায়?
সে তার নানুর কাছে গিয়েছে। তার শরীরটা ভালো না।
কী হয়েছে?
জ্বর বমি এইসব। দেশের ওয়েদার তাকে স্যুট করছে না।
শওকত আগ্রহ নিয়ে বলল, ইমনকে কবে নিয়ে যাব?
রেবেকা বলল, ওর জন্মদিন কবে তোমার কি মনে আছে?
না। ভুলে গেছি।
আমারো তাই ধারণা। ওর জন্মদিন এই মাসের নয় তারিখ। তুমি পাঁচ তারিখ এসে ওকে নিয়ে যাবে। তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি চা নিয়ে আসছি।
ড্রয়িংরুমে শওকত এখন একা। সে আগেও একা বসেছিল, তখন নিজেকে একা একা মনে হয় নি। এখন মনে হচ্ছে। সবচে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে রেবেকা যখন বলল, আমি সঙ্গে করে ইমনকে নিয়ে এসেছি, তখন সে বুঝতেই পারে নি ইমনটা কে? যখন বুঝতে পারল তখন হঠাৎ সব জট পাকিয়ে গেল। সে ভুলে গেল এই মাসের নয় তারিখে ইমনের জন্মদিন। সে কখনো এই দিন ভুল করে না। ঐ দিন সে একটা সাদা ক্যানভাসে মনের সুখে হলুদ রঙে মাখায় লেমন ইয়েলো। কারণ শওকত তার ছেলের নাম রেখেছিল লেমন ইয়েলো। রঙের নামে নাম। ছেলের জন্ম হলো মিডফোর্ট হাসপাতালে। ছেলেকে দেখে সে বিস্মিত হয়ে বলেছিল— একী! এই ছেলে দেখি সন্ধ্যার আকাশের সমস্ত লেমন ইয়েলো রঙ নিয়ে চলে এসেছে। আমি এই ছেলের নাম রাখলাম লেমন ইয়েলো!
লেমন ইয়েলো দেশে এসেছে। সে তার বাবার সঙ্গে কয়েকদিন থাকবে।
রেবেকা চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকেছে। শওকত আবারো উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার উঠে না দাঁড়ালেও চলত। কেন দাঁড়াল সে নিজেও জানে না।
রেবেকা বলল, তুমি এখন কী করছ?
শওকত বলল, একটা ডেইলি পেপারে ইলাস্ট্রেশন করি। আর দুটা ম্যাগাজিনে পার্ট টাইম ইলাস্ট্রেশন করি। বইমেলার সময় বইয়ের কাভার করি। সেট ডিজাইন করি।
তোমার চলে যায়?
হুঁ। দেশে টাকা পাঠাতে হয় না। মা মারা গেছেন। আমার নিজের তো আর টাকা বেশি লাগে না।
তোমার মার মৃত্যু তাহলে তোমার জন্যে একটা রিলিফের মতো হয়েছে। প্রতি মাসে টাকা পাঠাতে হবে এই টেনশন নেই।
শওকত ক্ষীণ স্বরে বলল, ঠিকই বলেছ।
রেবেকা বলল, যে কয়দিন ইমনকে রাখবে তার খাওয়া-দাওয়ার দিকে লক্ষ রাখবে। হোটেলের কোনো খাবার বা ফাস্ট ফুড খাওয়াবে না। খাওয়া নিয়ে সে মমাটেও যন্ত্রণা করে না। এক গ্লাস দুধ, এক পিস পাউরুটি, একটা হাফ বয়েলড় ডিম হলেই তার হয়।
তুমি চিন্তা করো না, আমি বাইরের খাবার খাওয়াব না।
ছবি আঁকাআঁকি কি বন্ধ?
বন্ধই বলা চলে।
ছবি আঁকছ না কেন?
ইচ্ছা করে না।
ছেলেকে যখন কাছে নিয়ে রাখবে, তখন একটা দুটা ছবি আঁকার চেষ্টা করবে। ইমন তার বাবার ছবি আঁকা নিয়ে খুব একসাইটেড।
ও আচ্ছা।
ফাদারস ডে-তে তাদের স্কুলে বাবাকে নিয়ে রচনা লিখতে বলা হয়েছিল। ইমন একটা দীর্ঘ রচনা লিখেছে। রচনার শিরোনাম হচ্ছে My Painter Father.
বলো কী?
আমি তার রচনাটার ফটোকপি নিয়ে এসেছি। তোমাকে দিয়ে দেব। এটা পড়া থাকলে ছেলে তার বাবা সম্পর্কে কী ভাবছে তা তোমার জানতে সুবিধা হবে। আমি চাই এই অল্প কয়েকটা দিন ইমন যেন আনন্দে থাকে।
আমি চেষ্টা করব। ইমনকে নিতে কবে আসব?
আগেই তো বলেছি, পাঁচ তারিখে চলে এসো।
এখন তাহলে উঠি?
এক মিনিট দাঁড়াও, ইমনের লেখা এসেটা তোমাকে দিচ্ছি। ইমন যেন জানতে না পারে, সে লজ্জা পাবে।
ওকে কিছু বলব না।
একটা কথা তোমাকে বলতে ভুলে গেছি— রাতে কিন্তু সে অন্ধকার ঘরে ঘুমুতে পারে না। অবশ্যই ঘরে বাতি জ্বালিয়ে রাখবে।
হুঁ রাখব।
তোমার বাসায় কি এসি আছে?
না।
এখন অবশ্য গরম সেরকম না। ঠিক আছে, তুমি যে অবস্থায় থাক ছেলে সেই অবস্থাটাই দেখুক। তার জন্যে আলাদা কিছু করতে হবে না।
ইমনের লেখা ইংরেজি রচনার বাংলাটা এরকম–
আমার পেইন্টার বাবা
আমার বাবা থাকেন বাংলাদেশে। সেখানের সবচে বড় শহরটার নাম টাকা। তিনি ঢাকায় থাকেন এবং দিনরাত ছবি আঁকেন। গাছপালার ছবি, নদীর ছবি এইসব। তিনি গাছপালার ছবি বেশি আঁকেন কারণ বাংলাদেশে অনেক গাছ। পুরো দেশটা সবুজ। এই জন্যেই বাংলাদেশের পতাকার রঙও সবুক। সবুজের মাঝখানে লাল সূর্য আঁকা।
আমার বাবাকে আমি খুবই পছন্দ করি। তিনি আমাকে পছন্দ করেন কি-না আমি জানি না। মনে হয় করেন না। কারণ তিনি কখনোই আমার বার্থডেতে কোনো কার্ড পাঠান নি। এই নিয়ে আমি মোটেও মন খারাপ করি না। কারণ তিনি খুব ব্যস্ত মানুষ। তাঁকে দিন-রাত ছবি আঁকতে হয়।