ওস্তাদ বাশি ভালো বাজাচ্ছেন। ছবি তত ভালো হচ্ছে কি-না বোঝা যাচ্ছে। নীল রঙের নানান শেড পড়ছে। বেহাগের রঙ কি নীল?
শওকত ভাই! একা একা ঝিম ধরে বসে আছেন কেন? আমাকে চিনতে পারছেন?
স্কার্ট পরা লাল চুলের এই মহিলাকে চেনা যাচ্ছে না। তবে গলার স্বর চেনা। মিষ্টি গলা।
আমি রুমা!
ও আচ্ছা রুমা ভাবি! আমি চিনতে পারি নি। ঘরে ঢোকার পর থেকে মনে মনে খুঁজছিলাম— তৌফিকের বউ কোথায়?
রুমা বলল, চিনতে পারার কথাও না। আয়নায় যখন নিজেকে দেখি, খুবই অচেনা লাগে। চুল রঙ করিয়েছি। থ্যাবড়া নাক ছিল, তিন হাজার পাউন্ড খরচ করে নাক ঠিক করেছি। নাক ঠিক হয়েছে না? আপনি আর্টিস্ট মানুষ, আপনি ভালো বলতে পারবেন।
শওকত বলল, ভাবি, আমি এখন আর্টিস্ট না। আমি ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছি।
ছাড়লেন কেন?
ভালো লাগে না।
বাঁশির সুরের সঙ্গে ছবি আঁকার ব্যাপারটা আপনার কাছে কেমন লাগছে?
তেমন ভালো লাগছে না।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্টের ফরম বদলাবে। অনেক পপ জিনিস ঢুকে যাবে। আর্টকে জনপ্রিয় করার জন্যে এর প্রয়োজনীয়তা আছে।
আছে হয়তো।
হয়তো বলবেন না ভাই। নিশ্চয়ই আছে। আগে ক্রিকেট খেলা হতো পাঁচদিন, এখন হচ্ছে ওয়ানডে। সময়ের সঙ্গে সবকিছুকেই তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
শওকত হাসল। রুমা ভাবির মতো একশ পারসেন্ট খাঁটি বাঙালি মেয়ের তর্ক করার ভঙ্গিতে কথা বলা দেখতে মজা লাগছে।
ভাই, আপনার হাত খালি কেন? অন্য কিছু না খান, শ্যাম্পেনের বোতল খোলা হয়েছে, শ্যাম্পেন খান। আমার সঙ্গে গ্লাস ঠোকাঠুকি করে শ্যাম্পেন খেতে হবে। নিয়ে আসি? আজ আমাদের একটা বিশেষ দিন।
বিশেষ দিনটা কী?
আজ আমাদের বিয়ের দিন। আপনি কেন ভুলে গেলেন? আমরা গোপনে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করলাম। আপনি সাক্ষী ছিলেন। আমাদের হাতে কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। আপনি আমাদের তিনশ টাকা দিলেন। মনে পড়েছে?
ঘটনাটা মনে পড়েছে। কত টাকা দিয়েছিলাম মনে নাই।
আমার মনে আছে। টাকাটা আপনি দিয়েছিলেন আমার হাতে। কী কষ্টের দিন যে গেছে! পুরনো দিনের কথা আমার অবশ্য মনে পড়ে না। অ্যালকোহল বেশি খেয়ে ফেললে তখন মনে আসে। ভাই, আনি আপনার জন্যে এক গ্লাস শ্যাম্পেন?
আনুন।
আপনার বন্ধু স্পেনে একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন। ঐসব দেশে বাড়িঘর কেনা খুব সহজ। সামান্য কিছু ডাউন পেমেন্ট করলেই কেনা যায়। একবার আসুন না স্পেনে? আপনাদের মতো আর্টিস্টদের জন্যে ইন্টারেস্টিং জায়গা।
শওকত আবারও হাসল। পার্টি তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। ঘরের আলো কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ওস্তাদ বংশিবাদক ভালো বাজাচ্ছেন।
নিমন্ত্রিত অতিথিরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নিচু গলায় গল্প করছেন। মাঝে-মাঝে গ্লাসের টুং টাং শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বিদেশী কোনো ছবির পৃশ্য। মন্দ কী!
শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে শওকত প্রায় ফিসফিস করে বলল—
এইখানে এই তরুর তলে
তোমায় আমায় কৌতূহলে
যে কটি দিন কাটিয়ে যাব প্রিয়ে
সঙ্গে রবে সুরার পাত্র
অল্প কিছু আহার মাত্র
আরেকখানি ছন্দ মধুর কাব্য হাতে নিয়ে।
রুমা তার হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছে। একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করলেও এখন আর কেউ চোখ সরু করে তার দিকে তাকাবে না। শওকত কবিতা মনে করার চেষ্টা করছে। মনে পড়ছে না।
শওকত ঘোরলাগা মাথায় অনেক রাতে বাসায় ফিরল। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে, আবার ঘুম আসছে না এমন অবস্থা। এই অবস্থার সুন্দর ইংরেজি নাম আছে। নামটা মনে আসছে না। ইমন বাসায় থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করা যেত। ইমন নেই। আবার কখনো কি তাকে পাওয়া যাবে? পাঁচ সাত আট বছর পর হয়তো সে এলো। তখন যদি বলা হয়— হ্যালো বেবি, চা বানানো মনে আছে? খুব কড়া করে এক কাপ চা বানাও। দুধ-চিনি সবই বেশি বেশি দেবে।
ইমনের আর না আসাই ভালো।
অভ্যস্ত জীবনে হঠাৎ ঘূর্ণির কোনো প্রয়োজন নেই। সবাই সবার নিজের জীবনে থাকুক। প্রতিটি জীবন নদীর মতো। একটা নদীর সঙ্গে আরেকটা নদীর মিলে-মিশে যাওয়া খুব খারাপ ব্যাপার।
শওকত রাত সাড়ে তিনটায় মগ ভর্তি করে চা বানাল। ঘুমানোর আগে কড়া এক কাপ চা খেলে তার ঘুম ভালো হয়। আজ এমনিতেই ভালো ঘুম হবে, তারপরেও অভ্যাস ঠিক রাখা। মানুষ এমন এক প্রাণী যে যে-কোনো মূল্যে অভ্যাস ধরে রাখার চেষ্টা করে। সব কিছু চলে যাক, শুধু অভ্যাসটা থাকুক।
ঘুম আসছে না। অনেকদিন পর তাকে অদ্রিা ব্যাধিতে ধরেছে। আধ্যাত্মিক মানুষদের ব্যাধি এপিলেন্সি, আর সৃষ্টিশীল মানুষদের ব্যাধি অনিদ্রা। সে এখন কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ না। সে এখন হাবুগার মানুষ। হাবুগাবুরা খায়-দায়, বাথরুমে যায়, রাতে আরাম করে ঘুমায়।
জানালায় দিনের আলো ঢোকার পর শওকত ঘুমুতে গেল। পাশাপাশি দুটা বালিশ। একটা তার জন্যে, আরেকটা ইমনের জন্যে। ইমনের বালিশের এখন আর প্রয়োজন নেই। এই বালিশ সরিয়ে ফেলা ভালো। স্মৃতির মতো অস্পষ্ট বায়বীয় কোনো বিষয় জমা করতে নেই। শওকত ইমনের বালিশটা তুলে নিজের মাথার নিচে রাখতে গিয়ে দেখল, বালিশের নিচে ক্রিস্টমাস ট্রি আঁকা খাম। খামের উপর বাংলায় লেখা— বাবা।
ভেতরের কার্ডটা ইংরেজিতে লেখা। ক্রিসমাসের অভিনন্দন। কার্ডের সাদা পৃষ্ঠায় ইমন আবার সবুজ পেন্সিল দিয়ে গুটি গুটি করে ইংরেজিতে আট-নয় লাইন লিখেছে। ইংরেজির বাংলা তরজামা অনেকটা এরকম–
আমি কল্পনায় ভেবে রেখেছিলাম তুমি কেমন। কল্পনার সঙ্গে মোটেও মিলে নি। তুমি কল্পনার বাবার চেয়েও অনেক বেশি ভালো। তুমি ছবি আঁকা ভুলে গেছ কেন? ছোটরা অনেক কিছু ভুলে যায়, বড়রা তো ভোলে না। তুমি কেন ভুলে গেলে?
ইমন খুব আগ্রহ করে কী যেন আঁকছে
ইমন খুব আগ্রহ করে কী যেন আঁকছে। এলিয়েনের ছবি হবার সম্ভাবনা। শিশুরা একটা বয়সে এলিয়েনের ছবি আঁকতে পছন্দ করে। আমেরিকান শিশু মনস্তত্ত্ববিদরা বিষয়টা নিয়ে নানান গবেষণা করেছেন। গবেষণার ফলাফল পত্রপত্রিকায় প্রকাশিতও হচ্ছে। মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে আসা হয়েছে যে, এলিয়েনদের ছবি আঁকা শিশুর মনোজগতের এলিয়েনেশনের সঙ্গে সম্পর্কিত না।