জানি। সে বলেছে।
কী বলেছে?
অদ্ভুত কথা বলেছে। সে বলেছে, আনিকার গানের গলা ক্রিস্টেল গেইলের চেয়েও ভালো।
ক্রিস্টেল গেইল কে?
আমি জানি না কে। আমেরিকান কোনো পপ সিঙ্গার হবে। আমাকে ইমন অনুরোধ করেছে—তোমার একটা গানের সিডি যেন তাকে দেই। তুমি যে গান গাইতে পার, তাই তো আমি জানি না।
জানার চেষ্টা কর নি বলে জানো না। আশেপাশের মানুষদের প্রতি তোমার কৌতূহল খুব কম।
হয়তো কম।
ভাত খেয়েছ?
না।
তোমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে, তোমার মনটা খুব খারাপ। সম্ভব হলে আমি এসে তোমাকে ভাত খাইয়ে যেতাম। বুঝতেই পারছ সেটা সম্ভব না।
বুঝতে পারছি।
আজ রাতে খামারের মালিকের সঙ্গে চাইনিজ খেয়েছি। তার সঙ্গে চাইনিজে যাওয়ার ব্যাপারটা না থাকলে আমি আসতাম। আমার সিক্সথ সেন্স বলছিল তোমার ছেলে সন্ধ্যাবেলা চলে যাবে। ভালো কথা, খামার মালিকের সঙ্গে চাইনিজ খাওয়ায় তুমি রাগ করো নি তো?
রাগ করব কেন?
ভদ্রলোককে আমার পছন্দ হয়েছে। সামান্য বোকা, সেটা কিছু না। ভদ্রলোক এমন ভাব করছিলেন যেন তিনি অতি তুচ্ছ একজন। আর আমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিদুষী। রূপে মিস এশিয়া।
ভালো তো!
কিছু কিছু মানুষ আছে যারা প্রেমিক হিসেবে মোটেই ভালো না। কিন্তু স্বামী হিসেবে অসাধারণ। আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা।
প্রেমিকরা আদর্শ স্বামী হয় না?
হয় না। তারা আদর্শ স্বামী যেমন হয় না, আদর্শ পিতাও হয় না। তোমার নিজের কথাই ধর। তুমি কি আদর্শ পিতা?
না।
রাগ করলে আমার কথায়?
না।
প্লিজ রাগ করো না। তোমাকে রাগানোর জন্যে আমি কিছু বলছি না। তুমি অসহায় একজন মানুষ। অসহায় মানুষকে রাগাতে নেই।
অসহায় মানুষকে কী করতে হয়? করুণা?
হ্যাঁ, এরা করুণাভিক্ষা করে জীবন পার করে দেয়। করুণা পেতে পেতে এরা অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন করুণা না পেলে তাদের ভালো লাগে না।
তুমি কি খামার মালিককে বিয়ে করার কথা ভাবছ?
একেবারেই যে ভাবছি না তা না। রাতে যখন ঘুমুতে গেছি, তখন মনে হয়েছে আগের চ্যাপ্টারটা ফেলে দিয়ে নতুন একটা চ্যাপ্টার লেখা শুরু করলে কেমন হয়!
আমার মতামত চাও?
আমি কীভাবে আমার জীবন সাজাব সেটা আমি ঠিক করব। অন্যের মতামত কেন নেব! এখন বাসায় যাও। খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাও।
আনিকা, আমার ছেলে তোমার জন্যে একটা গিফট রেখে গেছে। একদিন এসে নিয়ে যাবে।
কী গিফট?
এক মুঠো পার্ল। সে মোমবাতি দিয়ে পার্ল বানিয়েছে।
তোমার ছেলের মতো শান্ত বুদ্ধির ছেলে আমি আমার জীবনে দেখি নি। আমার জীবনে অনেক হতাশা আছে। তোমার ছেলেকে দেখে আরেকটা হতাশা যুক্ত হয়েছে।
সেটা কী?
আমার কেন কোনোদিন এরকম একটা ছেলে হবে না!
কেন হবে না? অবশ্যই হবে!
আনিকা হঠাৎ বলল, তোমার সঙ্গে এখন আর কথা বলতে ভালো লাগছে। রাখি।
শওকত বাসায় ফিরল না। রাত সাড়ে এগারোটার সময় তৌফিকের বাসার দরজার কলিংবেল বাজাল। তৌফিক নিজেই দরজা খুলে দিল। উল্লসিত গলায় বলল, আরে তুই! দি গ্রেট শ। (তৌফিক শওকতকে ডাকে শ। এই শ নাকি শওকতের শ না, শালার শ।)
শওকত বলল, আছিস কেমন?
চমৎকার আছি। বাসায় পার্টি চলছে। তরল নেশা, বায়বীয় নেশা— সব ব্যবস্থাই আছে। তুই ভালো সময়ে এসেছিস। বারটা এক মিনিট থেকে বাঁশি শুরু হবে। ওস্তাদ মিনু খান এসেছেন। নাম শুনেছিস মিনু খানের?
না।
বলিস কী! তুই কোন ভুবনে বাস করিস যে মিনু খানের নাম জানিস না?
জমজমাট পার্টিতে ঢুকে শওকত অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। অপরিচিত সব নারী-পুরুষ। তাদের চোখের দৃষ্টি ঘোরলাগা। গলার স্বর জড়ানো। তৌফিক শওকতকে পরিচয় করিয়ে দিল হলেও হতে পারত মহান শিল্পী দি গ্রেট শ।
একসঙ্গে পঁচিশ-ত্রিশজন চেঁচিয়ে বলল, চিয়ার্স। কেউ একজন হাতের গ্লাস দেয়ালে ছুড়ে ফেলল। এই জাতীয় পার্টিতে আনন্দমাত্রা অতিক্রম করলে গ্লাস ভাঙতে হয়। তাই নিয়ম।
রাত বারটা এক মিনিটে ওস্তাদ মিনু খান বাঁশিতে বেহাগ বাজাতে শুরু করলেন। তৌফিক বড় একটা ক্যানভাসের সামনে রঙ-তুলি নিয়ে বসল। বেহাগের সুর সে ক্যানভাসে আনবে। এই উদ্দেশ্যেই আজকের পার্টি।
বাঁশিতে বেহাগ বাজছে। তৌফিক ব্রাশ টানছে। তার ব্রাশের টানে কোনো দ্বিধা নেই। যেন সে জানে সে কী করছে।
শওকত ঘরের এক কোনায় বসে আছে। তৌফিকের শক্ত হাতে ব্রাশ টানা দেখতে তার ভালো লাগছে। সতের-আঠার বছরের অত্যন্ত রূপবতী এক তরুণী এসে শওকতকে বলল, আপনি শুধু হাতে বসে আছেন— এটা কেমন কথা! খুব ভালো রেড ওয়াইন আছে। পর্তুগিজ। এনে দেব?
শওকত বলল, না। আমার শরীর খারাপ।
আপনার কী হয়েছে?
আমি একজন মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ।
তাই না-কি? মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত কোনো মানুষের সঙ্গে আমি আগে কখনো গল্প করি নি। আপনার সঙ্গে কি গল্প করতে পারি?
হ্যাঁ পারেন।
আচ্ছা বলুন তো, বাঁশির সুর কি কোনো পেইন্টার তার ক্যানভাসে ধরতে পারেন?
দুটা দুরকম জিনিস।
কোন অর্থে দুরকম? সুর এবং রঙ আলাদা কোন অর্থে?
আপনি কি সত্যি জবাবটা চান?
আপনার কি মনে হয় আমি জবাবটা চাই না?
শওকত বলল, আপনি জবাবটা শুনতে চাচ্ছেন না। আপনার কথা বলতে ভালো লাগছে বলেই আপনি কথা বলছেন।
মেয়েটি উঠে চলে গেল।
শওকতেরও উঠে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। আবার ছবিটা কী দাঁড়ায় সেটাও দেখতে ইচ্ছা করছে। শওকতের মনে হলো ইমনকে এই অনুষ্ঠানে নিয়ে এলে সে মজা পেত। একজন বাঁশি বাজাচ্ছে আর আরেকজন সেই বাঁশির সুর ক্যানভাসে ধরতে চেষ্টা করছে। ছোটদের অদ্ভুত জগতে এই ঘটনা অতি রোমাঞ্চকর।