আমি অবশ্যই সাইকেল কিনে দেব।
তুমি তোমার নিজের জীবনটা গোছাবার চেষ্টা কর। ভেজিটেবল হয়ে বেঁচে থাকার মানে হয় না।
শওকত হাসল। রেবেকা বিরক্ত গলায় বলল, তোমার পাশ কাটানো হাসিটা হাসবে না। তোমার অনেক জিনিসের মতো তোমার নন কমিট্যাল হাসিও আমার পছন্দ না। সাইকেল কেনার টাকা না থাকলে আমার কাছ থেকে নিতে পার।
টাকা আছে।
শওকত উঠে দাঁড়াল। রেবেকাও সেই সঙ্গে উঠল। শওকত বলল, যাই? রেবেকা বলল, যাও। তোমাকে যে প্রতি রাতে বোবায় ধরত, সেই অসুখটা কি এখনো আছে?
আছে।
এই অসুখের ভালো চিকিৎসা বের হয়েছে। এটা একটা সাইকো সমেটিক ব্যাধি। টাইম পত্রিকার গত অক্টোবর সংখ্যায় এই রোগটার উপর বড় একটা আর্টিকেল বের হয়েছে। আমি টাইম পত্রিকাটা নিয়ে এসেছি। দেব তোমাকে?
দরকার নেই।
অনেক রাতে ইমন টেলিফোন করল তার মাকে। তার গলা কাঁদো কাদো। গলা শুনে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই সে কেঁদেছে। কান্না শেষ হয় নি। এখনো বুকে জমে আছে।
ইমন ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, বাবা আমাকে সাইকেল গিফট করেছে।
রেবেকা বললেন, এটা তো খুবই আনন্দের ঘটনা। অ্যান্ডারসনের সিক্সথ সেন্স কাজে লেগেছে। আনন্দের ঘটনায় তুমি বোকা ছেলের মতো কাঁদছ কেন?
জানি না। কেন জানি আমার শুধু কান্না পাচ্ছে।
তুমি কি আমার কাছে চলে আসতে চাও?
হ্যাঁ।
তোমার বাবাকে বলো, সে তোমাকে দিয়ে যাবে।
আচ্ছা।
আরেকটু ভেবে তারপর বললা। গাড়ি কি পাঠাব?
হ্যাঁ, পাঠাও।
পাঠাচ্ছি। লক্ষ্মীসোনা, কাঁদবে না।
ছেলের কান্নার শব্দে শওকত বের হয়ে এলো। তার নিজের বুকে একটা ধাক্কার মতো লাগল। কেন ছেলেটা এমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে? তার ছোট্ট হৃদয়ে এত কী কষ্ট!
শওকত বলল, বাবা, কী হয়েছে?
ইমন ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি জানি না কী হয়েছে। আমি কনফিউজড।
কেন বাবা?
ইমন নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলল, আমি কেন তোমাদের দুজনের সঙ্গে থাকতে পারছি না— এটা ভেবে কনফিউজড।
কাছে আসো, তোমাকে আদর করে দেই।
ইমন শান্ত গলায় বলল, না। Please, dont touch me.
কিছুক্ষণ আগে গাড়ি এসে
কিছুক্ষণ আগে গাড়ি এসে ইমনকে নিয়ে গেছে। সে কোনো স্মৃতিচিহ্ন রেখে যায় নি। মার কাছ থেকে আসার সময় যা যা নিয়ে এসেছিল, খুব গুছিয়ে প্রতিটি জিনিসই তার ব্যাক প্যাকে ভরেছে।
শওকত ভেবেছিল— পাজেরো জিপ স্টার্ট নিয়ে যখন সামনে যেতে থাকবে, তখন ইমন জানালা দিয়ে মাথা বের করে একবার হলেও হাত নাড়বে। বিদেশী বাচ্চাদের মতো বাই বা এই জাতীয় কিছু বলবে। তা সে বলে নি। জানালা দিয়ে মাথাও বের করে নি।
শিশুদের মনোজগৎ আলাদা। তারা তাদের ক্ষুদ্র হৃদয় দিয়ে অনেক হিসাবনিকাশ করে। সেই হিসাব-নিকাশের রহস্য বড়রা বুঝতে পারে না।
ইমন চলে যাবার পর শওকতের নিজেকে ভারমুক্ত মনে হলো। যেন এই কদিন মাথার উপর অদৃশ্য চাপ ছিল। এখন সেই চাপটা নেই। মানুষ হিসেবে সে এখন মুক্ত মানুষ। শুধু একটা সমস্যা হচ্ছে, বাসাটা হঠাৎ জনমানবশূন্য মনে হচ্ছে। যেন এই বাসায় কিছুদিন আগেও অনেক লোক বাস করত, এখন কেউ নেই। আবারও পুরনো অবস্থায় ফিরে যেতে সময় লাগবে।
শওকত ঘর তালাবন্ধ করে বের হলো। একা একা কিছুক্ষণ হাঁটবে। বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই। একসময় ফিরলেই হলো।
তৌফিকের বাসায় যাওয়া যায়। ছবি এঁকে সে খুব নাম করেছে। জাপান ন্যাশনাল মিউজিয়ামে তৌফিকের একটা পেইন্টিং আছে। প্রায়ই শোনা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তার ছবির শো হচ্ছে। হঠাৎ খ্যাতিতে তৌফিক বদলেছে কি-না তা দেখে আসা যায়। বছর ছয় আগেও তৌফিকের সঙ্গে দেখা হওয়া ছিল আতঙ্কজনক ব্যাপার। তৌফিক অবধারিতভাবে জাপ্টে ধরে বলবে— দোস্ত, পকেটে যা আছে সব দিয়ে দে। আমার অবস্থা ভয়াবহ।
সেই তৌফিক ধানমণ্ডিতে বিশাল ফ্ল্যাট কিনেছে। সেই ফ্ল্যাটে ছবি আঁকার স্টুডিও না-কি দর্শনীয়।
রাস্তায় নেমেই তৌফিকের বাসায় যাবার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে শওকত টেলিফোনের দোকানে ঢুকে গেল। ইমন বাড়িতে ঠিকমতো ফিরেছে কি-না জানা দরকার। রেবেকাই টেলিফোন ধরল।
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রেবেকা বলল, ইমন ঠিকমতো ফিরেছে। তুমি কি কথা বলবে ইমনের সঙ্গে?
শওকত বলল, ইমন কী করছে?
লেবুর শরবত বানিয়ে দিয়েছি, শরবত খাচ্ছে।
তোমরা নিউইয়র্ক কবে যাবে?
টিকিটের উপর নির্ভর করছে। টিকিট পেলেই চলে যাব।
যাবার তারিখটা কি জানাবে?
জানাব। তোমার কোনো ফোন নাম্বার আছে যেখানে জানাতে পারি?
না নেই।
লোক পাঠিয়ে খবর দেব। রাখি তাহলে।
রেবেকা টেলিফোন রেখে দেবার পর শওকতের মনে হলো, ইমনের সঙ্গে কথা বলা হলো না। সে কি আবার টেলিফোন করে ইমনকে চাইবে? তেমন বিশেষ কোনো কথাও তো নেই যে এই মুহূর্তেই বলতে হবে। কেমন আছ ইমন? এখন কী করছ? মাকে দেখে ভালো লাগছে?– এর বাইরে তো আর কিছু নেই জিজ্ঞেস করার মতো।
শওকত আনিকাকে টেলিফোন করল। আনিকা ঘুম ঘুম গলায় বলল, কী ব্যাপার?
শওকত বলল, কয়টা বাজে?
আনিকা বলল, কয়টা বাজে জানার জন্যে টেলিফোন করেছ? দশটা পঁচিশ।
বলো কী! এত রাত হয়েছে? ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
হ্যাঁ।
তাহলে রাখি, পরে কথা হবে।
ঘুম যখন ভাঙিয়েই দিয়েছ, কথা বলো। ছেলে কোথায়?
মার কাছে চলে গেছে।
একা একা লাগছে, সেই জন্যে টেলিফোন?
হয়তোবা।
চলে যাবার সময় ছেলে কি কান্নাকাটি করেছে?
না।
তোমার ছেলে খুব শক্ত। তুমি বোধহয় জানো না সে আমাকে খুব পছন্দ করেছে।