আনিকা বলল, দাঁড়াও, আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে। এই বুদ্ধিতে মনে হয় কাজ হবে।
ইমন আগ্রহের সঙ্গে বলল, কী বুদ্ধি?
বুদ্ধিটা এখনো ঠিকমতো জমে নি। মানে হলো মাথায় পুরোপুরি আসে নি। আসি আসি করছে।
বুদ্ধি আনার ব্যাপারে আমি কি তোমাকে হেল্প করতে পারি?
না।
আমি চা বানানো শিখেছি। তুমি কি চা খাবে?
চা বানানো কার কাছে শিখেছ?
আমার বাবার কাছে।
আর কিছু শিখেছ?
খিচুড়ি বানানো শিখেছি, তবে সেটা কঠিন।
দেখি চা বানাও তো। সাবধান, আবার হাত পুড়িও না।
ইমন আগ্রহের সঙ্গে চা বানাতে গেল। দুই কচ্ছপের দৌড় দেয়ানোর জন্যে মেয়েটার চেষ্টা দেখে সে মুগ্ধ। ছোটদের কোনো কাজে বড়রা কখনোই এত আগ্রহ দেখাবে না।
চায়ে চুমুক দিয়ে আনিকা বলল, তুমি তো আসলেই চা ভালো বানিয়েছ। ছোটদের বানানো চায়ে একটা সমস্যা সবসময় থাকে— চা-টা হয় ঠাণ্ডা! তোমারটা হয় নি।
চা কীভাবে গরম বানাতে হয় বাবা শিখিয়েছে।
আনিকা বলল, মায়েরা তার ছেলেমেয়েদের অনেক কিছু শেখায়। মায়ের শেখানো কোনো কিছুই ছেলেমেয়েরা মনে রাখে না। বাবারা যা শেখায় তাই মনে রাখে।
ইমন বলল, তোমার বাবা তোমাকে কী শিখিয়েছিলেন?
পানিতে চাক্তি মারা।
সেটা কী?
একটা চাক্তি নিয়ে পুকুরের পানিতে ছুড়ে মারা। চাক্তিটা এমনভাবে ছুড়তে হয় যেন সেটা পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে যায়। দেখলে মনে হবে একটা ব্যাং পানির উপর লাফ দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
তোমার বাবা এটা তোমাকে শিখিয়েছেন?
হ্যাঁ। আমরা গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। পুকুরপাড়ে বসে আছি। বাবা এসে উপস্থিত। বাবাকে দেখে খুব ভয় পেলাম। দৌড়ে পালিয়ে যাব ভাবছি, তখন…
বাবাকে ভয় পেলে কেন?
আমার বাবা অন্য বাবাদের মতো না। উনি কোনো কারণ ছাড়াই তার ছেলেমেয়েদের বকাঝকা করেন।
কিন্তু তিনি তোমাকে চাক্তি মারা শিখিয়েছেন।
হ্যাঁ, তা শিখিয়েছেন।
তুমি কি আমাকে শেখাতে পারবে?
হ্যাঁ পারব।
কখন শেখাবে?
এখনই শেখাতে পারি। আমার দরকার কয়েকটা চাক্তি আর একটা পুকুর।
চাক্তি এবং পুকুর কোথায় পাওয়া যায়?
ঢাকা শহরেই পাওয়া যায়। চল রমনা লেকে যাই।
কচ্ছপ দুটাকে কি রেখে যাব, না সঙ্গে নিয়ে যাব?
আমার মনে হয় সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই ভালো হবে।
আনিকার পুকুরের পানিতে চাক্তিমারা দেখে ইমন হতভম্ভ হয়ে গেল। আসলেই মনে হচ্ছে পানি স্পর্শ করে লাফিয়ে লাফিয়ে একটা ব্যাং যাচ্ছে।
ইমন বলল, তোমার এবং তোমার বাবা তোমাদের দুজনের অনেক বুদ্ধি।
এটা ঠিক না। আমরা দুজনই বোকা। বেশ বোকা। আমি একটু কম। আমার বাবা একটু বেশি।
পানিতে চাক্তি মারা ছাড়া তুমি আর কী জানো?
আর কিছু জানি না। তবে গান গাইতে পারি।
বাংলা গান?
হ্যাঁ, বাংলা গান। শুনবে?
শুনব।
আনিকা সঙ্গে সঙ্গেই গান শুরু করল মদিনাবাসী প্রেমে ধর হাত মম। স্কুলের অনুষ্ঠানের পর আনিকা আর গান গায় নি। বহু বছর পর আবার গাইছে। সে নিজেই অবাক হয়ে লক্ষ করল, খুব ভালো গাইছে তো! গলায় সুর আছে। ভালো মতোই আছে। গান গাইতে গাইতে আনিকার চোখ ভিজে গেল।
ইমন বলল, তুমি কাঁদছ কেন?
আনিকা বলল, গান গাইতে গাইতে আমি কল্পনায় দেখছিলাম আমি তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলের একটা পার্কে বসে গান করছি— সবাই খুব মজা করে আমার গান শুনছে।
ইমন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এই অদ্ভুত মহিলার কথাগুলি সে বোঝার চেষ্টা করছে। বুঝতে পারছে না।
আনিকা বলল, ইমন, আমার গান কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে। আরেকবার গাও।
আনিকা সঙ্গে সঙ্গে গাইতে শুরু করল। পার্কে লোকজন তেমন নেই। সকাল দশটা-এগারোটার দিকে রমনা লেকে কেউ বেড়াতে আসে না। তারপরও কিছু লোকজন আছে। তাদের কেউ কেউ কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। কয়েকজন আবার গান শোনার জন্যে এগিয়ে আসছে। আনিকা চোখ বন্ধ করে গাইছে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ইমন খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে। এই মহিলা এমন করে কাঁদছে কেন— সে বুঝতে পারছে না। তারচেয়েও বড় কথা তার নিজের খুব কান্না পাচ্ছে।
রেবেকা এবং শওকত মুখোমুখি বসে আছে। শওকত ভয়ে ভয়ে ছিল। রেবেকা প্রথমেই কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করবে— ছেলেকে কার কাছে রেখে এসেছ? সে তা করে নি। শওকত ছেলের জন্মদিনে তাকে নিতে এসেছে শুনে সে সহজভাবে বলল, আমরা দুজন একসঙ্গে উপস্থিত থাকলে ইমন বিব্রতবোধ করবে। সে মাকে খুশি রাখবে না বাবাকে খুশি রাখবে— এটা নিয়ে কনফিউজড হয়ে যাবে। তাকে নিয়ে আমি অনেক জন্মদিন একা একা করেছি। আজকেরটা তুমি কর। তুমি কি তার জন্যে কোনো গিফট কিনেছ?
শওকত বলল, না। কী কিনব বুঝতে পারছি না। সে কী পছন্দ করে?
বাচ্চা মানুষ তো, যা দেবে তাই পছন্দ করবে। তবে তুমি তাকে একটা সাইকেল কিনে দিতে পার। তার সাইকেলের খুব শখ। একা একা চালাতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করবে ভেবে আমি কিনে দেই নি।
সাইকেল?
হ্যাঁ। তার সাইকেলের খুব শখ।
সাইকেল তো সে সঙ্গে করে আমেরিকা নিয়ে যেতে পারবে না।
তা পারবে না। সাইকেল থাকবে তোমার কাছে। সেটা খারাপ কী? স্মৃতি থাকল। পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে। সাইকেল কেনার মতো টাকা কি তোমার কাছে আছে?
আছে।
তাহলে তাকে একটা সাইকেল কিনে দাও। অ্যান্ডারসন তোমার ছেলেকে গোপনে বলেছে যে, তুমি তাকে একটা সাইকেল দেবে। অ্যান্ডারসনের কথা সত্যি হয় কি-না তা দেখার জন্যে ইমন মনে মনে অপেক্ষা করছে।