শওকত বলল, চা খেয়ে যাও।
চা এক কাপ খেতে পারি।
আনিকা ইমনের চেয়ারটায় বসল। বাসায় দুটাই চেয়ার। ইমন তার চেয়ার খালি করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুগ্ধ দৃষ্টি সে একবারও কচ্ছপ দুটা থেকে সরাচ্ছে না।
আনিকা বলল, আমি তোমার এখানে আসতে আসতে ভাবছিলাম, খুব সুন্দর একটা ছেলে দেখব। কিন্তু এত সুন্দর কাউকে দেখব ভাবি নি। তোমার ছেলের চেহারায় কোথায় যেন দেবদূত দেবদূত ভাব আছে। ঠিক না?
শওকত জবাব না দিয়ে চা বানাতে গেল। ইমন আনিকার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কি এদের হাত দিয়ে ধরতে পারি? এরা কি কামড়ায়?
আনিকা বলল, এখন কামড়াবে না। তুমি ইচ্ছা করলে এদের হাতে নিতে পার। তবে এরা বড় হলে কিন্তু কামড়ায়। খুব শক্ত কামড়। এরা যখন কাউকে কামড়ে ধরে, তখন আর ছাড়ে না।
কামড়ে ধরেই থাকে?
হ্যাঁ।
তখন কী করলে এরা কামড় ছেড়ে দেয়?
কিছুতেই ছাড়ে না। মাঝে-মাঝে এমনও হয়েছে–গলা কেটে ফেলতে হয়েছে। তারপর ছেড়েছে।
খুব আশ্চর্য তো!
আশ্চর্যের কিছু নেই। মানুষের মধ্যেও এরকম কচ্ছপ স্বভাব আছে। কিছু মানুষ আছে যারা কচ্ছপের মতো। কাউকে কামড়ে ধরলে ছাড়ে না। যেমন আমি। আমি যদি কাউকে ধরি, তাহলে ছাড়ি না। মৃত্যু পর্যন্ত ধরে রাখি।
ইমন বলল, তুমি কাকে ধরেছ?
আনিকা বলল, আপাতত তোমাকে ধরেছি।
ইমন একটা কচ্ছপ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। তার মাথায় কোনো পরিকল্পনা আছে।
শওকত চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আনিকা, তুমি আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলার সময় সাবধানে বলবে। সে খুব স্মার্ট ছেলে। তুমি যা বলবে তা তো সে বুঝবেই, যা বলবে না তাও বুঝবে।
আনিকা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, আমি যদি কিছুক্ষণ তোমাদের সঙ্গে থাকি, তোমাদের অসুবিধা হবে?
শওকত বলল, অসুবিধা হবে কেন?
প্রশ্নের জবাব প্রশ্ন দিয়ে দিও না। অসুবিধা হবে কি হবে না সেটা বলো।
অসুবিধা হবে না। বরং আমার খুবই লাভ হবে। আমি দুই-তিন ঘণ্টার জন্যে বাইরে যাব। ছেলেকে তোমার কাছে রেখে যেতে পারি। তিন ঘণ্টা থাকতে পারবে?
পারব।
তোমাকে অফিসে যেতে হবে না?
তোমাদের সঙ্গে আজ বেশকিছু সময় থাকব। দুপুরে তোমাদের রান্না করে খাওয়াব— এই ভেবে আমি আজ ছুটি নিয়েছি। তুমি থাকতে দেবে কি দেবে না— এই ভেবে শুরুতে অফিস থেকে ছুটি নেবার কথা বলি নি।
দুপুরে কী খাওয়াবে?
তোমার ছেলে যা খেতে চায়, তাই খাওয়াব।
তুমি রান্না করতে জানেনা তা জানতাম না।
আমি অনেক কিছুই জানি, যা তুমি জানো না।
রান্না যে করবে— জিনিসপত্র লাগবে না?
সেই ব্যবস্থা আমি করব। নিউমার্কেট থেকে বাজার করে আনব। তোমার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাব। সে কি যাবে আমার সঙ্গে?
যাবে। কচ্ছপ দিয়ে তুমি তারে কজা করে ফেলেছ।
আনিকা বলল, আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি যাদেরকে কজা করতে চাই তাদের কজা করতে পারি না। আর যাদের কজা করার আমার কোনো প্রয়োজন নাই, তারা কীভাবে কীভাবে যেন কজায় চলে আসে।
খারাপ কী? কেউ না কেউ তোকজায় আসছে।
খারাপ বলছি না তো! ইয়েলো ক্যাবের ড্রাইভারের কথা তোমার মনে আছে?
কোন ড্রাইভার?
আকবর নাম। যার গাড়িতে করে তোমাকে তুলে মগবাজার কাজি অফিসে গিয়েছিলাম। সে এখন কজায় চলে এসেছে। আমি যাতে গান শুনতে পারি, সেজন্যে সে তার গাড়ির ক্যাসেটপ্লেয়ার ঠিক করেছে। মাঝে-মধ্যেই সে বাসায় চলে আসে, আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবার জন্যে।
বিনা পয়সায় ট্যাক্সি চড়ায়, না-কি টাকা নেয়?
টাকা নেয়। ট্যাক্সিড্রাইভার ছাড়া আরো একজনকে কজা করেছি।
সে কে?
নাম জামাল। খামারের মালিক। গরু-ছাগল পুষে। পুকুরে মাছ চাষ করে। কাল সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় চা খেতে এসেছিল। তার চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝেছি, আমাকে তার অসম্ভব মনে ধরেছে। আমি খুবই অবাক হয়েছি।
অবাক হবার কী আছে? তুমি কি মনে ধরার মতো মেয়ে না?
এক সময় হয়তো ছিলাম, এখন নাই। আমার চেহারা কথাবার্তা সব কেমন জানি শুকনা হয়ে গেছে। দশটা-পাঁচটা চাকরি করি বলে হয়তো এরকম হয়েছে।
শওকত জবাব দিল না। আনিকা কেমন যেন দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে আছে। তার মুখ দেখে মায়া লাগছে।
আনিকা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার ছেলে কবে যাবে?
পরশু।
মন খারাপ?
শওকত জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। আনিকাকে দেখে সে খানিকটা স্বস্তি বোধ করছে। ঘণ্টা দুই-তিন সময় তার আসলেই দরকার। পত্রিকা অফিসে যেতে হবে। ইলাসট্রেশনের কাজ করে দিয়ে আসতে হবে। দেরি হয়ে গেছে। মাসুম সাহেব এই দেরি সহজভাবে নেবেন বলে মনে হয় না। মেজাজ গরম মানুষ। হুট করে বলে বসতে পারেন আপনাকে আমাদের দরকার নেই। আপনি আপনার পথ দেখুন। আমরা আমাদের পথ দেখব। ইলাসট্রেশন হিসেবে কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং চালাচ্ছেন। কাক-বক দিয়ে আর চলবে না। মাসুম সাহেবের সঙ্গে দেখা করারও আগে ইমনের মার সঙ্গে দেখা করা দরকার। ছেলের জন্মদিনে উপস্থিত থাকার নিমন্ত্রণ। ইমন বলছে তার মা আসবে না। কিন্তু শওকতের ধারণা সে আসবে। অনেকদিন ছেলেকে দেখে নি। বিশেষ একটি দিনে ছেলের সঙ্গে থাকার সুযোগ সে নষ্ট করবে না। রেবেকা কঠিন মেয়ে, কিন্তু এত কঠিন না।
ইমন খুবই ব্যস্ত দুই কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজনে। আনিকা এই বিষয়ে তাকে সাহায্য করছে। মেঝেতে চক দিয়ে দুটা লাইন টানা হয়েছে। কচ্ছপ দুটিকে একসঙ্গে ছাড়া হচ্ছে। দুজনের একজন সোজাসুজি যাচ্ছে, অন্যজন শুরুতেই নব্বই ডিগ্রি টার্ন করছে। ইমন এবং আনিকা দুজন হাল ছাড়ার পাত্র না। তারা চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। আনিকা শুকনা মরিচের গুঁড়া এনে কচ্ছপের দৌড়ের জায়গা ছাড়া অন্য সব দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এতে তেমন কোনো লাভ হয় নি। শুকনা মরিচ ছড়ানো জায়গায় কচ্ছপ যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু তারা দুজনই দৌড়ানো বন্ধ করে দিয়েছে।