বাহ্ ইন্টারেস্টিং তো!
আমাকে আর্টস এন্ড ক্রাফট ক্লাসে শিখিয়েছে।
আসো, তাহলে কাজ শুরু করা যাক। তুমি বানাবে মুক্তা, আমি বানাবো ভূত। তার আগে তুমি মার সঙ্গে কথা বলে এসো। সে নিশ্চয়ই তোমার টেলিফোনের জন্যে অপেক্ষা করে থাকে।
ইমন বাধ্য ছেলের মতো মাকে টেলিফোন করতে গেল। শওকত লক্ষ করল, টেলিফোন করার জন্যে সে বারান্দায় চলে গেছে। মাকে সে কখনো বাবার সামনে টেলিফোন করে না। মার জগতটা সে বাবার কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে। একইভাবে বাবার জগতটাও সে নিশ্চয় মার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। মাতা-পুত্রের কথাবার্তা আড়াল থেকে শোনার ক্ষীণ ইচ্ছা শওকতের হলো। ইচ্ছাটাকে সে পাত্তা দিল না। ছেলেকে ভোলানোর জন্যে ছবি আঁকতে হবে। লেকের মাঝ থেকে উঠে আসছে দুষ্ট বুড়ো। জোছনার ছবি। মেরিন ব্লু, ডার্ক আম্বার, আইভরি ব্ল্যাক, হোয়াইট। চারটা রঙ। অনেকদিন ছবি আঁকা হয় না। শওকতের মধ্যে টেনশন কাজ করতে শুরু করেছে। সাদা বোর্ডটা যেন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। সে যেন গম্ভীর গলায় বলছে— আমার গায়ে রঙ ভরাতে যাচ্ছ। খুব সাবধান! খুব সাবধান।
ইমন প্রথম কথা বলল, কেমন আছ মা?
রেবেকা বললেন, আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
ভালো।
শুধু ভালো, না বেশ ভালো?
বেশ ভালো।
আজ দুপুরে কী দিয়ে খেয়েছ?
খিচুড়ি।
শুধু খিচুড়ি?
হ্যাঁ। বাবা আর আমি আমরা দুজনে মিলে বেঁধেছি।
তুমি কি রান্নাও শিখে যাচ্ছি নাকি?
হ্যাঁ। আমি চা বানাতেও পারি।
বলো কী?
চা বানানো যে এত সহজ আমি আগে জানতাম না।
আগে জানতে না–এমন অনেক কিছুই এখন জানবে। ভালো কথা, তোমার বাবার বাসায় কি কোনো কাজের মানুষ নেই?
না। সকালবেলা রহিমার মা বলে একজন মহিলা এসে ঘর ঝাঁট দেন। বাসন ধুয়ে দেন। তিনি এখন আসছেন না। তবে তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
রাতে কী খাবে?
রাতেও খিচুড়ি খাব। দুপুরে আমরা বেশি করে রান্না করেছি। অর্ধেক রেখে দিয়েছি রাতের জন্যে।
তুমি যদি চাও, আমি হোটেল সোনারগাঁ থেকে পিজা কিনে পাঠাতে পারি।
মা লাগবে না।
আমি যতদূর জানি পিজা তোমার খুবই পছন্দের খাবার।
খিচুড়িও আমার খুব পছন্দের খাবার মা।
তাহলে তো ভালোই। অ্যান্ডারসন তোমাকে একটা ফ্যাক্স পাঠিয়েছে। তোমাকে কি পড়ে শোনাব?
হ্যাঁ।
হ্যালো লিটল কাউবয়। হ্যাভিং ফান? এই দুই লাইন। তুমি যদি ফ্যাক্সের উত্তর দিতে চাও, আমাকে বলো, আমি উত্তর পাঠিয়ে দেব।
উত্তর দিতে চাই না।
কেন চাও না? আমি যতদূর জানি তুমি অ্যান্ডারসনকে খুব পছন্দ কর।
আমি তাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই, এই জন্যে উত্তর দিতে চাই না। এখন উত্তর দিলে সারপ্রাইজ হবে না।
কী সারপ্রাইজ?
সেটা আমি তোমাকে বলব না। মা শোন, বাবা এখন আমার জন্যে একটা ছবি আঁকছে।
ভালো। হোক, ছবি আঁকাআঁকি হোক। শুভরাত্রি ইমন।
শুভরাত্রি।
শওকত অতি দ্রুত ব্রাশ ঘসছে। অনভ্যাসে কি বিদ্যাস হয়েছে? কজির ফ্লেক্সিবিলিটি কমেছে? কজি সে-রকম ঘুরছে না। একজন পেইন্টারের জন্যে কালান্তক ব্যাধির নাম আর্থরাইটিস। আঙুল নড়বে না, কজি নড়বে না। সামান্য একটু নাড়ালেই তীব্র ব্যথায় ভুবন অন্ধকার হয়ে যাবে। তারপরেও তাঁকে আঁকতে হবে। একজন সঙ্গীত-সাধকের কালান্তক ব্যাধি বধিরতা। তিনি সঙ্গীত সৃষ্টি করবেন কিন্তু কিছু শুনতে পাবেন না। মোজার্টের জীবনে এই ব্যাপারটি ঘটেছিল। তারপরেও তিনি মহান সঙ্গীত তৈরি করেছেন। শওকতের এই সমস্যা নেই। আর্থরাইটিসে তার আঙুল অচল হয় নি, তারপরেও সব কেমন আটকে আটকে যাচ্ছে।
ইমন গভীর মনোযোগে মোমের মুক্তা বানাচ্ছে। সবগুলি মুক্তা এক সাইজের হলে ভালো হতো। তা হচ্ছে না। একটার সঙ্গে একটা লেগে যাচ্ছে। নিয়ম হচ্ছে, মোমের প্রতিটি ফোঁটা আলাদা আলাদা ফেলতে হবে। তা সে পারছে না। এক সঙ্গে দুটা-তিনটা ফোঁটা পড়ে যাচ্ছে। তার উচিত হাতে ধরে থাকা মোমবাতির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। তা সে পারছে না। মাঝে-মাঝেই ঘাড় ফিরিয়ে সে তার বাবাকে দেখছে। বাবার চেহারা এখন একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। মুখের চামড়া কঠিন। ভুরু কুঁচকানো। চেহারায় কেমন যেন রাগী রাগী ভাব। ছবি আঁকার সময় কি মানুষের চেহারা রাগী রাগী হয়ে যায়? ইমনের তা মনে হয় না। তাদের আর্টের টিচারের চেহারা কখনো রাগী রাগী হয় না। বরং উল্টোটা হয়, চেহারা কোমল হয়ে যায়। তিনি আবার ছবি আঁকার সময় মাথা দুলিয়ে গানও করেন—
Can you hear the drums Farando?
I remember another story nights like this
In the fire lights Farnando!
এই গানটা তাদের আর্ট টিচারের খুব পছন্দ। কারণ তাঁর নিজের নামও Farnando.
শওকত ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, মুক্তা বানানো কেমন হচ্ছে?
ইমন বলল, ভালো।
পিংক কালারের মোম কিনে আনব, তাহলে পিংক পার্ল বানাতে পারবে। তোমার কি ক্ষিধে লেগেছে?
না।
ক্ষিধে লাগলে বলবে, আমরা ডিনার করে নেব।
আচ্ছা। বাবা শোন, তোমাকে আমি যদি একটি ছবি দেই, সেই ছবি দেখে তুমি কি মানুষটাকে আঁকতে পারবে?
পারার তো কথা।
তাহলে তুমি একটা ছবি এঁকে দিও। ছবিতে মানুষটা সোফায় শুয়ে বই পড়ছে। কিন্তু চশমটা তার চোখে না। কপালে। উনি বই পড়ার সময় চশমাটা তার কপালে তুলে দিয়ে বই পড়েন।
মানুষটা কে?
মিস্টার অ্যান্ডারসন।
উনি কি তোমাকে খুব পছন্দ করেন?
হ্যাঁ। আমাকে ডাকেন লিটল কাউবয়।