স্যার, আপনার পানি।
থ্যাংক য়্যু।
স্যার, আর কিছু লাগবে?
না, আর কিছু লাগবে না।
চা আরেক কাপ দেই?
না, থ্যাংক য়্যু।
আকবর নামের মানুষটা হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। Uninteresting Face. এই চেহারার পোট্রেট করা যায় না। একটা সময় ছিল যখন নতুন কোনো মুখ দেখলেই সে মনে মনে ঠিক করে ফেলত এই মুখের পোট্রেট করা যায় কি যায় না। পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে সে দুভাগে ভাগ করেছিল— Intersting Face, Uninteresting Face. Interesting Face-এর বাংলা কী হবে? মজাদার চেহারা, না-কি আকর্ষণীয় চেহারা? আকর্ষণীয় চেহারা অবশ্যই হবে না। অনেক চেহারা মোটেই আকর্ষণীয় না, কিন্তু খুবই interesting.
চা শেষ হয়ে আসছে। আকবরের কথানুসারে এর মধ্যেই তার ম্যাডামের চলে আসার কথা। হয়তো যে-কোনো মুহূর্তে চলে আসবে। তার ম্যাডামের নাম রেবেকা। শওকতের সঙ্গে বিয়ের পর নামের শেষে সে শওকতের শ লাগাত। সে লিখত রেবেকা শ। নাম শুনলে মনে হতো বার্নাড শর ভাতিজি।
রেবেকার সঙ্গে তার বিয়ে মাত্র সাত বছর টিকেছে। আরো সূক্ষ্ম হিসাব করলে বলতে হয় বিয়ে টিকেছে ছয় বছর নয় মাস। তার বিবাহিত জীবন শেষ হলো ছয়-নয়ে। ছয়-নয়ের প্যাচ কঠিন প্যাচ।
শওকতের চা এবং সিগারেট দুটাই এক সঙ্গে শেষ হয়েছে। আকবরের কথা শুনে আরেক কাপ চায়ের কথা বললে ভালো হতো। দ্বিতীয় কাপ চা এবং দ্বিতীয় সিগারেটের সঙ্গে কিছু অ্যাডভান্স চিন্তা করে রাখা। যেমন রেবেকা যখন ঘরে ঢুকবে সে তখন কী করবে? সম্মান দেখানোর মতো উঠে দাঁড়াবে? যে মেয়েটির সঙ্গে সে সাত বছর বিবাহিত জীবনযাপন করেছে, তাকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখানোর মধ্যে সামান্য হলেও কমেডি এলিমেন্ট আছে। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর কোনো মানে হয় না। আবার গঁাট হয়ে বসে থাকা আরো হাস্যকর। রেবেকা এখন অন্য আরেকজনের স্ত্রী। সমাজের সম্মানিত মহিলা। তাকে সম্মান দেখানো দোষের কিছু না। শওকত যদি কাঠের গুড়ির মতো বসে থাকে, তাহলে রেবেকা হয়তো ভুরু কুঁচকে বিরক্তি বিরক্তি ভাব নিয়ে তাকাবে। কিন্তু শওকত যদি অতি বিনয়ী হয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাড়ায়, তাহলে রেবেকা কিছুটা লজ্জা পাবে। লজ্জা পুরোপুরি কাটার আগেই শওকত বলবে, রেবেকা কেমন আছ? আবেগবর্জিত স্বাভাবিক সৌজন্যমূলক প্রশ্ন।
রেবেকা বলবে, ভালো।
তারপরই শওকত আরো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলবে, মিস্টার অ্যান্ডারসন কেমন আছেন?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে রেবেকা একটু হলেও থতমত খাবে। আগের স্বামীর মুখে বর্তমান স্বামীবিষয়ক প্রশ্ন কোনো মেয়েরই সহজভাবে নেবার কথা না।
সরি, তোমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি।
রেবেকা পেছন দিক থেকে কখন ঘরে ঢুকেছে শওকত বুঝতেই পারে নি। সে চট করে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সামনের টেবিলের কোনায় হাঁটুর খোচা লাগল। পিরিচে রাখা চায়ের কাপটা পিরিচে পড়ে কাত হয়ে পড়ে গেল। কাপে চা ছিল না। চা থাকলে চা গড়িয়ে বিশ্রী কাণ্ড হতো।
শওকত বলল, কেমন আছ রেবেকা?
রেবেকা বসতে বসতে বলল, ভালো আছি।
শওকতের এখন দ্বিতীয় প্রশ্নটা করার কথা। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার রেবেকার স্বামীর নাম এখন আর মনে পড়ছে না। শওকত নিশ্চয়ই বলতে পারে না, রেবেকা, তোমার আমেরিকান স্বামী কেমন আছেন? শওকতের স্মৃতিশক্তি দুর্বল না, রেবেকার স্বামীর নাম সে জানে। নিউজার্সিতে এই ভদ্রলোকের পুরনো বইয়ের একটা দোকান আছে। দোকানের নাম All gone! বাংলা করলে হয় সব চলে গেছে। ভদ্রলোক এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসথেটিকস পড়াতেন। রেবেকার সঙ্গে সেখানেই তার পরিচয়। ছাত্র পড়াতে ভালো লাগে না বলে তিনি পুরনো বইয়ের দোকান দিয়েছেন। তার এখন সময় কাটছে পুরনো বই পড়ে। শওকতের সব কিছু মনে পড়ছে। ভদ্রলোকের নামটা শুধু মনে পড়ছে না। তার সাময়িক ব্ল্যাক আউট হয়েছে।
রেবেকা বলল, তোমার কি শরীর খারাপ না-কি?
শওকত বলল, না তো!
রেবেকা বলল, কেমন কপাল টপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছ।
একটা কথা মনে করার চেষ্টা করছি। কিছুতেই মনে পড়ছে না।
রেবেকা বলল, চেষ্টা বেশি করলে মনে পড়বে না। রিলাক্সড থাক। মনে পড়বে।
শওকত এই প্রথম রেবেকার দিকে তাকাল। যেসব বাঙালি মেয়ে দেশের বাইরে থাকে তাদের চেহারায় আলগা এক ধরনের লালিত্য দেখা যায়। গায়ের রঙও হয় উজ্জ্বল ও রেবেকাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার বয়স কমে গেছে। চেহারায় কেমন যেন বিদেশিনী বিদেশিনী ভাব চলে এসেছে। এরকম হয়েছে চুলের কারণে। রেবেকার চুল ছিল লম্বা এবং কোঁকড়ানো। কোঁকড়ানো ভাব এখন আর নেই। চুল কেটে সে ছোটও করেছে। তবে এতে তাকে দেখতে খারাপ লাগছে না। বরং আগের চেয়েও সুন্দর লাগছে।
শওকত বলল, তুমি আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছ।
রেবেকা বলল, থ্যাংক য়্যু।
শওকত বলল, মিস্টার অ্যান্ডারসন কেমন আছেন?
বলেই সে খুব তৃপ্তি বোধ করল। নামটা শেষপর্যন্ত মনে পড়েছে।
রেবেকা বলল, সে ভালো আছে। এই নামটাই কি তুমি মনে করার চেষ্টা করছিলে?
শওকত বলল, হ্যাঁ।
রেবেকা বলল, চা খাবে?
চা একবার খেয়েছি।
আরেকবার খাও। আমি সকালে কোনো নাশতা করি না। এক কাপ চা আরেকটা টোস্ট বিস্কিট খাই। আজ এখনো খাওয়া হয় নি। তোমার সঙ্গে খাব বলে অপেক্ষা করছিলাম।
চা দিতে বলো।
তুমি নাশতা খেয়ে এসেছ?
হ্যাঁ।
কী নাশতা করলে?
পরোটা আর বুটের ডাল।