গাড়িতে ক্যাসেটপ্লেয়ার আছে? ক্যাসেটপ্লেয়ার থাকলে গান শুনব। আমি ক্যাসেট কিনে এনেছি।
ক্যাসেটপ্লেয়ার নষ্ট। ঠিক করব ঠিক করব বলে ঠিক করা হয় না। টেক্সিক্যাবে সবাই এসি চায়। কেউ গান শুনতে চায় না। টেক্সিক্যাবে উঠে গান শুনবে এত সৌখিন মানুষ বাংলাদেশে নাই। বিলেত-আমেরিকায় থাকলে থাকতে পারে।
আপনি কথা কম বলে গাড়ি চালান। আপনি কথা বেশি বলেন।
ড্রাইভার বলল, একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করব, তারপর আর কিছু জিজ্ঞেস করব না। ফাঁকা রাস্তায় যতক্ষণ বলেন ঘুরব।
আনিকা বলল, কথাটা কী?
উনার সঙ্গে কি পরে দেখা হয়েছে?
কার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
ঐ যে ভদ্রলোক যাকে বিয়ে করতে গেলেন। কাজি অফিসের সামনে থেকে ঐ লোক ছুটে গেল। আমার পরিবারকে ঘটনাটা বলেছিলাম, সে মনে খুবই কষ্ট পেয়েছে।
আপনি অনেক কথা বলে ফেলেছেন, আর কথা বলবেন না।
জি আচ্ছা।
আপনার ছেলেমেয়ে আছে?
একটা মেয়ে, ক্লাস টুতে পড়ে।
মেয়ের নাম কী?
উজ্জলা।
উজ্জলা আবার কেমন নাম?
মেয়ের গায়ের রঙ উজ্জ্বল, এই জন্যে তার মা শখ করে নাম রেখেছে উলা। ভালো নাম মুসাম্মত উজ্জলা বেগম।
আনিকা হাতে ধরে রাখা কচ্ছপটা ড্রাইভারের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, এই কচ্ছপটা রাখুন। উজ্জলাকে দেবেন। আমার উপহার। আর শুনুন, এখন থেকে কোনো কথা বলবেন না। মুখ বন্ধ করে গাড়ি চালাবেন। একটা শব্দ যদি বলেন, আমি গাড়ি থেকে নেমে যাব। শব্দও বলতে হবে না, গলা খাকারি দিলেও নেমে যাব।
গাড়ির এসি সত্যি ভালো। আনিকার এখন শীত শীত লাগছে।
একটা পাতলা সুতির চাদর থাকলে ভালো হতো। সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা। গাড়ির ক্যাসেটপ্লেয়ারটা ভালো থাকলে গান শোনা যেত— মদিনাবাসী প্রেমে ধর হাত মম। হাত প্রেমে ধরতে হয়। অপ্রেমে হাত ধরা যায় না। সে যে শওকতের হাত ধরে আছে, সেই হাত কি প্রেমে ধরে আছে, না অপ্রেমে ধরে আছে? ইদানীং তার খুব ঘনঘন মনে হচ্ছে— শওকত নামের মানুষটার প্রতি তার কোনো প্রেম নেই। যা আছে তা অন্য কিছু। এই অন্য কিছুটা কী তা সে জানে না। খুব বুদ্ধিমান কোনো মানুষের সঙ্গে যদি পরিচয় থাকত, তাকে সে জিজ্ঞেস করত। মিসির আলির মতো বুদ্ধিমান কেউ। যিনি একটা দুটা প্রশ্ন করেই সব জেনে ফেলতেন। কিংবা তাকে প্রশ্নও করতে হতো না। তিনি চোখের দিকে তাকিয়েই বলে ফেলতেন।
আনিকা পা উঠিয়ে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে গুটিসুটি মেরে বসল। চোখ বন্ধ করল। এখন কেন জানি তার মনে হচ্ছে গাড়িতে গান বাজছে। এটা মন্দ না। গান হচ্ছে কল্পনায়।
কল্পনায় গান শুনতে শুনতে মিসির আলী সাহেবের সঙ্গে কথা বলা যায়। দেখা যেতে পারে এই বৃদ্ধ তার সমস্যার সমাধান করতে পারেন কি-না। সে কী জন্যে শওকত নামের মানুষটার সঙ্গে ঝুলে আছে। মিসির আলী প্রশ্ন করছেন, সে জবাব দিচ্ছে।
প্রশ্ন : উনার সঙ্গে তোমার কতদিনের পরিচয়?
উত্তর : অনেক দিনের।
প্রশ্ন : শোন আনিকা, তুমি এক-দুই শব্দে প্রশ্নের জবাব দেবে না। এক দুই শব্দে প্রশ্নের জবাব দিতে হয় পুলিশের কাছে। আমি পুলিশ না। আমার প্রশ্নের জবাব বিস্তারিতভাবে দেবে। সেই বিস্তারিত জবাব থেকে অনেক কিছু বের হয়ে আসবে। এখন বলো, শওকত নামের মানুষটার সঙ্গে তোমার কত দিনের পরিচয় এবং কীভাবে পরিচয়?
উত্তর : আমার বড়ভাই এবং উনি এক ক্লাশে পড়তেন। দুজনের মধ্যে খুবই বন্ধুত্ব ছিল। তারা দুজন এক সঙ্গে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। উনি ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। আমি পাঁচ বছর বয়স থেকেই তাকে চিনি।
উনার বিষয়ে আপনাকে একটা মজার কথা বলি— পাঁচ বছর বয়স থেকেই তাকে আমি নাম ধরে ডাকতাম। ভাইয়া তাঁকে ডাকত শওকত। আমিও ডাকতাম শওকত। হয়তো কোনো একদিন উনি বাসায় এসেছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে ভাইয়াকে বলতাম— ভাইয়া, শওকত এসেছে। ভাইয়া আমাকে বকাবকি করত। বলত, নাম ধরে ডাকছিস কেন? আমি বলতাম, তুমিও তো নাম ধরেই ডাক। একটু বড় হবার পর আমি শওকত ভাই ডাকা শুরুর চেষ্টা করি; তখন উনি বললেন, বাচ্চা একটা মেয়ে আমাকে নাম ধরে ডাকে, আমার খুব মজা লাগে। তুমি আমাকে নাম ধরেই ডাকবে।
প্রশ্ন : তোমার বড়ভাইয়ের প্রসঙ্গে বলো।
উত্তর : উনি আমার আপন ভাই ছিলেন না। উনি ছিলেন আমার সৎভাই। উনার মার মৃত্যুর পর বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। ভাইয়া আমাকে খুব আদর করতেন। আমার ভাইয়া আমাকে যে আদর করতেন, পৃথিবীর কোনো ভাই তার বোনকে এত আদর কখনো করে নি, ভবিষ্যতেও করবে না।
প্রশ্ন : উনি মারা গেছেন?
উত্তর : জি, উনি মারা গেছেন। আমি তখন সেভেনে পড়ি।
প্রশ্ন : তোমার ভাই কীভাবে মারা গেছেন?
উত্তর : সেটা আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছি না।
প্রশ্ন : অপঘাতে মারা গেছেন?
উত্তর : হ্যাঁ, অপঘাতে মারা গেছেন। ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন। আমার বাবা-মা দুজনই ভাইয়াকে খুব যন্ত্রণা দিতেন। সারাক্ষণ বকাবকি, সারাক্ষণ রাগারাগি। ভাইয়ার আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়াটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। বাবা বলতেন, সব বখাটেরা আর্ট কলেজে পড়তে যায়। এটার নাম আর্ট কলেজ না, এটার নাম বখাটে কলেজ। বাবা তার কলেজে পড়ার খরচ দেয়া বন্ধ করে দিলেন। তখন শওকত তার কলেজের বেতন দিত। রঙ-তুলি কিনে দিত। শওকতের অবস্থা তো ভালো ছিল না। তারও খুব কষ্ট হতো। শেষে ভাইয়া কলেজ ছেড়ে দিল। দিনরাত বসে বসে থাকত। তখন তার মধ্যে সামান্য মাথা খারাপের লক্ষণ দেখা দিল। রাত জেগে ছবি আঁকত। ছবির মানুষগুলির সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলত।