আজই খাওয়াব।
আজকের দিনটা ছুটি নিয়ে বাসায় যান। আত্মীয়স্বজনদের সুসংবাদটা দিন।
আনিকা চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হলো। এই আনন্দের খবরটা প্রথমেই শওকতকে দিতে ইচ্ছা করছে। সে কি মিষ্টি নিয়ে শওকতের বাসায় যাবে? শওকত যখন বলবে, মিষ্টি কিসের? সে বলবে, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে তার মিষ্টি। আমার চাচাশ্বশুর আমাকে দেখতে এসেছিলেন, তার মিষ্টি।
শওকতের বাসায় যাওয়া যাবে না। মিতুর শ্বশুরবাড়িতে অবশ্যি যাওয়া যায়। মিতুর বরের জন্যে একটা পাঞ্জাবি, এক প্যাকেট মিষ্টি।
আনিকা নিজের ঘরে ঢুকল। জাহানারা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কী লজ্জার ব্যাপার! দীর্ঘদিনের সহকর্মী আজ তাকে দেখে উঠে দাঁড়াচ্ছে। আনিকার লজ্জা লাগছে, আবার খুব ভালোও লাগছে। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। আজ ছুটি নেয়াই ভালো। প্রমোশন পেয়ে একজন একটু পর পর আনন্দে কাদছে এই দৃশ্য দেখে সবাই আড়ালে হাসাহাসি করবে। সে এখন একজন ক্লাস ওয়ান গেজেটেড অফিসার। তাকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করার সুযোগ সে দেবে না।
প্রমোশনের খবর মনে হয় সবাই জেনে গেছে। অফিস থেকে বের হতেই কারপুলের এক ড্রাইভার ছুটে এসে বলল, আপা, কোথায় যাবেন?
আনিকা বলল, শরীরটা ভালো লাগছে না, বাসায় চলে যাব।
ড্রাইভার বলল, একটু দাঁড়ান আপা, গাড়ি নিয়ে আসি।
আনিকা বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। না না গাড়ি লাগবে না এই বলে সে কি হাঁটতে শুরু করবে? না-কি বলবে, আমাকে একটা রিকশা ডেকে দিন। তাতেই হবে।
আনিকা তার অফিসের গাড়িতে বসে আছে। কী বিস্ময়কর ব্যাপার। কোনো বিস্ময়ই মানুষ একা নিতে পারে না। আনিকার এমনই কপাল, তার জীবনের সমস্ত বিস্ময়কর ঘটনা সে আর কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে নি।
কত নাটকীয় ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে! এমন কি হতে পারে না হঠাৎ তার চোখে পড়বে রাস্তার এক মাথায় শওকত দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে, এই জায়গায় এসে তাদের গাড়ি জ্যামে আটকা পড়ল। গাড়ির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে আনিকা ডাকল। শওকত অবাক হয়ে কাছে এসে বলবে, সরকারি গাড়ি দেখছি! তুমি গাড়ি পাও জানতাম না তো! আনিকা তখন অবহেলার ভঙ্গিতে বলবে, আগে পেতাম না, এখন প্রমোশন হয়েছে। এখন পাচ্ছি।
প্রমোশন আবার কবে হলো?
বাদ দাও তো, প্রমোশন কবে হলো সেই আলাপ এখন করতে ইচ্ছা করছে না। তুমি সিগারেট ফেলে গাড়িতে উঠে আস।
আনিকা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। গাড়িতে উঠে আসতে বলাটা মনে হয় ঠিক হবে না। সরকারি গাড়িতে বাইরের লোক তোলার নিয়ম নিশ্চয়ই নাই।
ড্রাইভার বলল, আপা, আপনার বাসা কোন দিকে?
আনিকা বলল, বাসায় যাব না। আপনি একটা কাজ করুন, আমাকে নিউমার্কেটের গেটে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। আমি কয়েকটা ওষুধ কিনব।
আমি অপেক্ষা করি?
আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে না। আমাকে নামিয়ে দিয়ে আপনি চলে যাবেন। আমার দেরি হবে।
প্রথমেই আনিকা কয়েকটা গানের ক্যাসেট কিনল। তার মধ্যে নজরুলগীতির একটা ক্যাসেট আছে। সেখানে মদিনাবাসী প্রেমে ধর হাত মম গানটা আছে। ক্যাসেটগুলি কেনার পর পরই মনে হলো— শুধু শুধু টাকাগুলি নষ্ট করেছে। তাদের বাসায় ক্যাসেট শোনার কোনো যন্ত্র নেই। আনিকার সামান্য মন খারাপ হলো। অকারণে টাকা নষ্ট করতে তার মায়া লাগে। সে বেশ কৃপণ মেয়ে।
আজকের শুভদিনটা মনে রাখার জন্যে শওকতের জন্যে কিছু কেনা দরকার। দামি কিছু না। দুই আড়াইশ টাকার মধ্যে কিছু। একটা শার্ট কেনা যেতে পারে। আজকাল কাপড়-চোপড় সস্তা হয়েছে। দুই আড়াইশ টাকায় ভালো শার্ট পাওয়া যায়।
অনেক ঘোরাঘুরির পর একটা শার্ট আনিকার পছন্দ হলো। দাম তিনশ পঞ্চাশ টাকা। ফিক্সড প্রাইসের দোকান। এক টাকাও কমাবে না। তিনশ টাকায় শার্টটা কেনার সে অনেক চেষ্টা করল। দোকানদার রাজি হলো না।
আনিকা ঠিক করল শওকতকে কিছু না দিয়ে তার ছেলের জন্যে উপহার কিনবে। শওকতের জন্যে শার্টের বাজেট ছিল আড়াইশ টাকা। তার সঙ্গে আরো আড়াইশ যোগ করে পাঁচশ টাকা হবে। পাঁচশ টাকার মধ্যে কিছু। যে ছেলে আমেরিকার মতো জায়গায় বড় হয়েছে, তাকে নিশ্চয়ই এক-দেড়শ টাকার খেলনা দেয়া যায় না।
আনিকা অনেকগুলো দোকানে ঘুরল। কোনো কিছুই মনে ধরছে না। একটা কচ্ছপ শুধু পছন্দ হয়েছে। কচ্ছপটা সারাক্ষণ শুধু মাথা দোলায়। রঙ-বেরঙের কচ্ছপ কোনো কারণ ছাড়াই মাথা দোলাচ্ছে। দেখতে মজা লাগে। কচ্ছপটার দাম মাত্র একশ পঁচিশ টাকা। এত কম দামি জিনিস বিদেশী ছেলেকে উপহার দেয়া ঠিক না। আরো ভালো কিছু দেখতে হবে। জিনিসটা দেখতে সুন্দর হবে। দাম পাঁচশ টাকার মধ্যে থাকবে।
দুপুর দুটা পঁচিশ মিনিটে আনিকা নিউমার্কেট থেকে বের হলো। তার হাতে কচ্ছপ। একশ পঁচিশ টাকা দামের কচ্ছপ তাকে দোকানি দিয়েছে নব্বই টাকায়।
নিউমার্কেটের গেট থেকে বের হবার পরপরই একটা ইয়েলো ক্যাব এসে তার গা ঘেঁসে দাঁড়াল। ড্রাইভার মুখ বের করে বলল, আপা আমাকে চিনেছেন?
আনিকা বলল, হ্যাঁ চিনেছি।
কেমন আছেন আপা?
ভালো।
কোথায় যাবেন? উঠেন গাড়িতে উঠেন।
কোনো কথা না বলে আনিকা গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার বলল, বাসায় যাবেন, না ঐ দিনের মতো কিছুক্ষণ ঘুরবেন? আনিকা বলল, আপনার গাড়িতে কি এসি আছে? এসি থাকলে কিছুক্ষণ ঘুরব।
এসি আছে। নতুন গ্যাস ভরেছি, ভালো ঠাণ্ডা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখবেন গাড়ির মধ্যে মাঘ মাস।