ছেলেটা আনিকার কাছে এসে বলল, আফা, চা খাইবেন?
আনিকা বলল, যা ভাগ। থাপ্পড় খাবি।
আনিকা ভেবেই পাচ্ছে না ফট করে থাপ্পড় দেবার কথাটা সে কেন বলল। তার মেজাজ কি এতটাই খারাপ হয়েছে? প্রতি সপ্তাহে তার দুই-তিনদিন লেট হচ্ছে। অন্যদেরও লেট হচ্ছে। অন্যদেরটা কারোর চোখে পড়ছে না। তারটা চোখে পড়ছে। সেকশান অফিসার সিদ্দিক সাহেব গতকাল খুব ভালো মানুষের মতো তার ঘরে এসে বললেন, মিস আনিকা, আপনি কি দুই আড়াইশ টাকা খরচ করতে পারবেন?
আনিকা তটস্থ হয়ে বলল, কোন ব্যাপারে স্যার?
একটা দেয়ালঘড়ি কিনে আপনার শোবার ঘরে টানিয়ে রাখবেন। আজকাল দেয়ালঘড়ি সস্তা হয়ে গেছে। দুই আড়াইশ টাকায় ভালো ঘড়ি পাওয়া যায়। আমার ধারণা আপনার বাসায় কোনো দেয়ালঘড়ি নেই।
অপমানে আনিকার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। সে অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখে বলল, এইবার বেতন পেয়েই একটা ভালো ঘড়ি কিনব স্যার।
জ্যাম বোধহয় ছুটেছে। সব গাড়ি একসঙ্গে চলা শুরু করেছে। এতক্ষণ কারো কোনো ব্যস্ততা ছিল না। এখন ব্যস্ততার সীমা নেই— কে কার আগে যাবে! যেন অলিম্পিকের দৌড় প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ফার্স্ট হয়ে সোনা জিততে হবে।
এক ঘণ্টা বাইশ মিনিট লেট করে আনিকা অফিসে পৌঁছল।
সিদ্দিক সাহেব আজ কী বলবেন কে জানে! আজ হয়তো বলবেন— মিস আনিকা, আপনাকে অফিসের খরচে একটা ঘড়ি কিনে দেই?
শান্ত গলায় কঠিন অপমানের কথা একটা মানুষ কী করে বলে কে জানে! আনিকার ইচ্ছা করছে অফিসে না ঢুকে বাসায় চলে যেতে। পর পর তিনদিন বাসায় কাটিয়ে অফিসে হাজির হবে। যার যা ইচ্ছা বলুক।
যা ইচ্ছা করে তা করা যায় না। মানুষ চলে অনিচ্ছার পথে। তাকে বাধ্য হয়ে চলতে হয়। আনিকা তার ঘরে ঢুকল। তার ঘরে সে একা না, আরেকজন সিনিয়র কলিগ আছেন। জাহানারা। অফিসে তার নাম পান আপা। তিনি সারাক্ষণ পান খান। শুধু যে নিজে খান তা না, অন্যদেরও খাওয়াবার চেষ্টা করেন। ময়মনসিংহের মিকচার জরদা, মহেশখালির পান।
জাহানারা আনিকাকে দেখে কেমন যেন অন্যরকম চোখে তাকাল।
আনিকার বুক উঁৎ করে উঠল। আজ মনে হয় বড় কোনো ঘটনা ঘটেছে।
আনিকা বলল, আপা কেমন আছেন? আজ দেরি হয়ে গেল। কেউ কি আমার খোঁজ করেছিল?
জাহানারা শুকনা গলায় বললেন, বড় সাহেব দুবার এসে খোঁজ করেছেন। তোমাকে দেখা করতে বলেছেন।
আনিকা টোক গিলল। আজ ভালো যন্ত্রণা হবে। এখনো সময় আছে চেয়ারে না বসে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেই হয়। তিনদিন বাসায় শুয়ে বসে থাকবে। বেইলী রোডে নাটক পাড়ায় নাটক দেখবে, ফুচকা খাবে। একদিন যাবে শওকতের বাসায়। শওকত তার ছেলেকে নিয়ে কী আহ্লাদী করছে দেখবে। ছেলের জন্মদিনে শওকত কি তাকে ডাকবে? মনে হয় ডাকবে না। ডাকুক বা না ডাকুক, জন্মদিনের একটা উপহার তো কিনতে হবে। ছেলেদের উপহার কেনার যন্ত্রণা আছে। একটা দিন লাগবে উপহার বেছে বের করতে। যত কিছুই সে ভাবুক, শেষপর্যন্ত বড় সাহেবের কামরায় তাকে ঢুকতেই হবে। সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় নিজের স্বাধীনতায় সে আজ পর্যন্ত কিছুই করতে পারে নি।
সিদ্দিক সাহেব আনিকাকে দেখে বললেন, ও আচ্ছা আপনি এসেছেন। বসুন বসুন।
আনিকা বসল।
সিদ্দিক সাহেব তার সামনের খবরের কাগজ ভঁজ করে রাখতে রাখতে বললেন, আজকের কাগজ দেখেছেন? জোকস কর্নারে মজার একটা জোক ছাপা হয়েছে। টিচার ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেছে— ঘোড়া এবং হাতি, এদের পার্থক্য কী? ছাত্র বলেছে, ঘোড়ার লেজ পেছনে থাকে, হাতির লেজ সামনে থাকে। হা হা হা। এইসব জোকস এরা কোথায় পায় কে জানে!
আনিকা অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার আচারআচরণের কোনো মানে সে বুঝতে পারছে না।
মিস আনিকা!
জি স্যার।
আপনার কী রাশি বলুন তো।
তুলা রাশি। লিবরা।
আজকের দিনে আপনার রাশিফল কী বলছে দেখি— তুলা রাশি : বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের যন্ত্রণা থেকে দূরে থাকুন। দূরপাল্লার ভ্রমণে বের হবেন না। চাকরি ও ব্যবসায় আর্থিক গোলযোগের সম্ভাবনা। আপনি কি রাশিফলে বিশ্বাস করেন?
আনিকা বলল, আমি বিশ্বাসও করি না, অবিশ্বাসও করি না।
সিদ্দিক সাহেব হাসিমুখে বললেন, আমিও বিশ্বাস করি না, তবে আমার বেলায় খুব মিলে। আমি পত্রিকা খুলে প্রথম পড়ি রাশিফল। তারপর পড়ি জোকস, তারপর ফ্রন্ট পেইজে যাই।
আনিকা বুঝতে পারছে না এই মানুষটার সমস্যা কী? হড়বড় করে এত কথা কেন বলছে! কোনো একটা ঘটনা অবশ্যই ঘটেছে। ঘটনাটা কী?
মিস আনিকা!
জি স্যার।
আপনার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে। সুসংবাদ এবং সারপ্রাইজ। বিগ সারপ্রাইজ। চা খাবেন?
জি-না স্যার, চা খাব না। সারপ্রাইজটা কী?
আপনার প্রমোশন হয়েছে। আমাদের চাকরিতে প্রমোশন তো রেয়ার ঘটনা। দশ বছর বার বছর একই পোস্টে ঘটঘটর করেও কিছু হয় না। আপনার ভাগ্য খুবই ভালো। কনগ্রাচুলেশনস।
আনিকা হতভম্ব হয়ে গেল। তার প্রমোশন হয়েছে। তার মানে সে এখন সিদ্দিক সাহেবের ব্যাংকের একজন। অফিসের গাড়ি তাকে নিয়ে আসবে, দিয়ে আসবে। অফিসের কোয়ার্টারের জন্যে অ্যাপ্লাই করতে পারবে। সম্পূর্ণ তার নিজের আলাদা একটা ঘর হবে। ঘরের সামনে টুলের উপর পিওন বসে থাকবে।
মিস আনিকা!
জি স্যার।
আপনি কি খুশি হয়েছেন?
অবশ্যই খুশি হয়েছি। খুশি হবো না কেন? এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।
কল্পনার বাইরে থাকবে কেন? আপনি দুটা সেকশনাল পরীক্ষাতেই খুব ভালো করেছেন। আপনি কাজ-কর্মেও স্মার্ট। আপনার রেকর্ডস তো খুবই ভাললা। আমাদের মিষ্টি কবে খাওয়াবেন?