রেবেকা সারাদিন ছেলের টেলিফোনের জন্যে অপেক্ষা করেছে। ইমন টেলিফোন করে নি। রেবেকা খোঁজ নিয়েছে ইমনকে তার বাবা বাসা থেকে নিয়ে গেছে সকাল সাড়ে দশটায়। এখন বাজে সন্ধ্যা সাতটা। এর মধ্যে টেলিফোন আসে নি। মোবাইল টেলিফোনে টেলিফোন করার কায়দাকানুন তাকে খুব ভালো করে শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। ইমন কোনো বোকা ছেলে না যে ভুলে যাবে। তাকে বারবার বলা হয়েছে— বাবা যে বাসায় থাকে, সেখানে পৌঁছার পরই যেন টেলিফোন করা হয়। ইমন তা করে নি। রেবেকা যা করতে পারে তা হলো— ছেলের টেলিফোনের অপেক্ষা না করে নিজেই কাজটা করা। সেই ইচ্ছাও হচ্ছে না। তার খুবই চিন্তা লাগছে। ছেলেকে নিয়ে চিন্তা না। ছেলে কেন টেলিফোন করছে না— তা নিয়ে চিন্তা।
ইমনের টেলিফোন এলো রাত আটটায়। সারাদিনে সে কোনো টেলিফোন করে নি– এই নিয়ে রেবেকা কোনো কথা বলল না। যেন কিছুই হয় নি সেরকম গলার স্বর করে বলল, কেমন আছ ইমন?
ইমন বলল, ভালো।
ফান হচ্ছে?
হুঁ।
কী ফান হচ্ছে বলো তো?
ইমন জবাব দিল না। রেবেকা বললেন, সারাদিনে কী কী করলে সেটা বলো।
ইমন এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। রেবেকা শঙ্কিত বোধ করলেন। ছেলে যদি হঠাৎ কথা বন্ধ করে দেয়, তাহলে বুঝতে হবে সে আর মুখ খুলবে না। সামনে থাকলে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আবার কথা শুরু করা যেত, এখন সে সামনেও নেই।
রেবেকা ছেলের কথা শুরু করানোর জন্যে বললেন, ইমন, তুমি কি তোমার বাবাকে চাইনিজ লণ্ঠনটা দিয়েছ?
ইমন বলল, কিছুক্ষণ আগে দিয়েছি।
দিতে এত দেরি হলো কেন?
রিকশা থেকে নেমে হাত থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। আমি আরেকটা নতুন বানিয়ে কিছুক্ষণ আগে দিয়েছি।
সারাদিন বসে বসে চাইনিজ লণ্ঠন বানালে?
হুঁ।
বাবা রঙিন কাগজ কিনে আনল। গাম কিনে আনল। মোমবাতি আনল।
সারাদিন লণ্ঠন বানানো নিয়ে ব্যস্ত ছিলে বলে আমাকে টেলিফোন করতে পার নি। তাই না?
তোমার বাবা কি লণ্ঠন দেখে খুশি হয়েছে?
হ্যাঁ।
সে এখন কোথায়? কী করছে?
বাবা এখন আরেকটা লণ্ঠন বানাচ্ছে।
তাই নাকি?
হুঁ। আমি তো তিনটা রঙ ব্যবহার করেছি— লাল, সবুজ আর হলুদ। বাবা বলছে তিনটা রঙ ব্যবহার না করে একটা রঙের অনেকগুলি শেড ব্যবহার করে বানালে খুব সুন্দর হবে। যেমন ধরো সবুজ রঙ। বাবা এখন সবুজ রঙের পাঁচটা শেড় দিয়ে বানাচ্ছে।
সবুজ রঙের পাঁচটা শেড় তুমি পাবে কোথায়? বাজারে তো একটাই সবুজ রঙের কাগজ পাওয়া যায়।
সবুজ রঙের পাঁচটা শেড বাবা রঙ গুলে বানিয়েছে।
ও আচ্ছা, তোমার বাবা তো একজন পেইন্টার। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
ইমন বলল, মা, আমি এখন রাখি। বাবাকে সাহায্য করতে হবে। বাই।
রেবেকা কিছু বলার আগেই ইমন টেলিফোন রেখে দিল। খুব জরুরি প্রশ্ন রেবেকার করা হলো না— আজ দুপুরে সে কী খেয়েছে? খাবারটা কি ঘরে তৈরি হয়েছে, না বাইরে থেকে এসেছে?
শওকত খুব মন দিয়েই চাইনিজ লণ্ঠন বানাচ্ছে। ফ্রেম তৈরি হয়ে গেছে, এখন শুধু ফ্রেমে সবুজ রঙের কাগজ বসানো। ইমন আগ্রহ নিয়ে বাবার কাজ দেখছে। সে হাঁটু গেড়ে বাবার সামনে বসে আছে। তার হাতে আইকা গার্মের কৌটা। তার কাজ হচ্ছে কাগজে আইকা গাম লাগিয়ে দেয়া।
ইমন!
হুঁ।
আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।
কী আইডিয়া?
সবুজ রঙের উপর লাল রঙের একটা ফিগার আঁকব। সবুজের মধ্যে লাল খুব ভালো ফোটে। আমি কী করব শোন, যেখানে গাঢ় সবুজ রঙের কাগজ, সেখানে ফিগারটা আঁকব হালকা লাল রঙে। আবার যেখানে হালকা সবুজ রঙ ব্যবহার করেছি, সেখানে ফিগার আঁকা হবে গাঢ় লাল রঙে। এতে কী হবে জানো?
কী হবে?
লাল রঙের ইনটেনসিটি সমান মনে হবে। ফিগারটা থ্রি ডাইমেনশনাল হয়ে যাবে। লণ্ঠন জ্বালালে মনে হবে ফিগারটা লণ্ঠন থেকে বাইরে চলে এসেছে।
সত্যি?
আমার এরকম মনে হচ্ছে। শেষ না হলে বুঝতে পারব না।
কখন শেষ হবে?
বুঝতে পারছি না। সময় লাগবে।
আমি কিন্তু জেগে থাকব।
আচ্ছা। ইমন, তুমি কি চা বানাতে পার?
না।
এসো তোমাকে চা বানানো শিখিয়ে দেই। এখন তোমার কাজ হবে মাঝেমাঝে চা বানিয়ে আমাকে খাওয়ানো। পারবে না?
পারব। আমি মিল্ক শেক বানাতে পারি।
মিল্ক শেকের মতো জটিল বস্তু যে বানাতে পারে, চা বানানো তার কাছে কিছুই না। চা বানানো তার কাছে লেনটিল-রাইস।
লেনটিল-রাইস মানে কী?
লেনটিল-রাইস মানে হলো ডাল-ভাত। এটা একটা বাংলা বাগধারা। যার অর্থ খুবই সহজ কাজ। খুবই সহজ কাজের ইংরেজি বাগধারা কী?
ইমন বলল, A piece of cake.
জীবনের প্রথম চা ইমন বানাল রাত নটায়। তার কাছে মনে হলো, প্রথম কাপ চা বানিয়ে সে হঠাৎ অনেকখানি বড় হয়ে গেছে। শওকত চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে চলে। তবে তেমন ভালো হয় নি। দুধ বেশি হয়েছে। চিনিও বেশি হয়েছে। আমার ধারণা পরের বার থেকে ঠিক হয়ে যাবে।
ইমন লক্ষ করল, তার বাবার সঙ্গে তার মায়ের একটা বড় ধরনের অমিল আছে। ইমনের বানানো প্রথম চা যত খারাপই হোক, মা চুমুক দিয়েই বলত— অসাধারণ হয়েছে। আমি আমার জীবনে এত ভালো চা খাই নি। বাবা সে-রকম বলে নি। তার অর্থ হলো—বাবা যখন বলবে চা ভালো হয়েছে, তখন ধরে নিতে হবে চা ভালো হয়েছে।
ইমন আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন বাবা আবার চা খেতে চাইবে। সে বানাবে। এবারের চায়ে দুধ এবং চিনি কম দিতে হবে। চাইনিজ লণ্ঠনের নির্মাণ থেকে ইমনের আগ্রহ এখন অনেক কমে গেছে। এখন তার আগ্রহ চা বানানোতে।
আনিকা চিন্তাই করতে পারে নি
আনিকা চিন্তাই করতে পারে নি, আজও তার অফিসে পৌছাতে দেরি হবে। অন্যদিনের চেয়ে দশ মিনিট আগে সে ঘর থেকে বের হয়েছে। সেই হিসাব ধরলে পনেরো মিনিট আগে অফিসে পৌছানোর কথা, অথচ এলিফ্যান্ট রোডের জ্যামে সে চল্লিশ মিনিট ধরে আটকা পড়ে আছে। জ্যামের কারণ রাস্তার মাঝখানে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে একটি ট্রাক। ট্রাকের পাশের খালি জায়গাটা দিয়ে এক সঙ্গে দুটা গাড়ি ঢুকতে গিয়ে গিট্টু লেগে গেছে। কেউ নড়তে পারছে না। কারো তেমন মাথাব্যথাও নেই। সবাই গা ছেড়ে অপেক্ষা করছে। কিছু একটা হবে। কখন হবে কীভাবে হবে সেটা নিয়ে কারো কোনো টেনশন দেখা যাচ্ছে না। ফ্লাস্কে করে এক ছেলে রঙ চা বিক্রি করছে। অনেকেই আগ্রহ করে সেই চা খাচ্ছে।