ইমন বলল, হুঁ।
তোমার মা কই?
ইমন বলল, মা ছোটখালার বাসায় বেড়াতে গেছেন। আমাকে বলে গেছেন তুমি এলে তোমার সঙ্গে চলে যেতে।
তোমার সঙ্গে কী যাচ্ছে? অনেক পুটলা-পুটলি দেখছি। দাও কিছু আমার কাছে দাও। তোমার হাতেরটা দাও।
হাতেরটা দেয়া যাবে না।
হাতে কী?
চাইনিজ লণ্ঠন।
চাইনিজ লণ্ঠনটা তাহলে তোমার হাতেই থাকুক। ব্যাক প্যাকটা আমার কাছে দাও।
বাবার আরেকটা জিনিস ইমনের খুবই ভালো লাগল। তার মধ্যে ন্যাগিং ভাব নেই। সে যখন বলল, হাতের জিনিসটা দেয়া যাবে না, তখন বাবা এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেন নি। অন্য যে কেউ হলে বলত, কেন দেয়া যাবে না? মা শুধু এই প্রশ্ন করেই চুপ করে থাকত না। মা বলত, দেখি প্যাকেটটা খোল। আমি দেখতে চাই এটা এমন কী মহার্ঘ বস্তু যা আমার হাতে দেয়া যাবে না। মহার্ঘ বস্তু বাক্যটা মা ঘনঘন ব্যবহার করে। মহার্ঘ বস্তুর ইংরেজি হচ্ছে— Valuable goods.
রিকশা বড় রকমের একটা আঁকুনি খেল। ইমন সিট থেকে পড়ে যেতে ধরেছিল। শওকত খপ করে তাকে ধরে ফেলল। ইমন মোটেই অবাক হলো না। সে জানত বাবা তাকে কিছুতেই রিকশা থেকে পড়তে দেবেন না।
শওকত বলল, ইমন, তুমি তো বাংলা বেশ ভালো বলতে পার। অল্পবয়েসী বাচ্চারা বিলেত-আমেরিকায় গেলে ইংরেজিটা অতি দ্রুত শেখে। যত দ্রুত শেখে তার চেয়েও দ্রুত গতিতে বাংলা ভুলে যায়। তোমাদের নিউ জার্সির বাড়িতে তুমি কি বাংলায় কথা বলো?
মার সঙ্গে বাংলায় কথা বলি।
বাংলা পড়তে পার?
পারি। গল্পের বই পড়ি।
সবশেষ বাংলা বই কোনটা পড়েছ?
বিষের কাঁটা।
লেখকের নাম কি মনে আছে?
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
বলো কী! এই বই তো বাচ্চাদের জন্যে কঠিন।
কঠিন না— এটা একটা ক্রাইম সলভিং ডিটেকটিভ স্টোরি।
বাংলা বই কি তুমি নিজের আগ্রহেই পড়? না-কি তোমার মা জোর করে তোমাকে পড়নি?
প্রথম প্রথম বকা দিয়ে পড়াতেন। এখন নিজেই পড়ি।
আচ্ছা দেখি এখন তোমার বাংলা জ্ঞানের একটা পরীক্ষা হবে। বলো দেখি পানি শব্দটার ইংরেজি কী?
Water.
হয়েছে, দশে দশ পেয়েছ। বলো জল শব্দের ইংরেজি কী?
Water.
আবারো হয়েছে, দশে দশ। এখন বলো অষু শব্দটার ইংরেজি কী?
Water.
হয়েছে। এখন পেয়েছ দশে এগারো। এক নাম্বার বেশি দিয়ে দিলাম। দশে এগারো দেবার নিয়ম নেই, তবে আমি পরীক্ষক হিসেবে ভালো। আমি কাউকেই ফেল করাতে চাই না। আমি চাই সবাই পাস করুক। ভালো স্টুডেন্টরা দশে এগারো, বারো পাক।
ইমন মাথা নিচু করে হাসল। শওকত বলল, ইমন শোনো, আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে অষু শব্দটার মানে তুমি জানো না। তুমি অনুমানে বলেছ। যেহেতু পর পর দুটি শব্দের ইংরেজি হলো Water, তুমি ধরেই নিয়েছ পরেরটাও তাই হবে। আমার অনুমান কি ঠিক?
হুঁ ঠিক।
তাহলে তো তোমাকে দশে এগারো দেয়া যায় না। নাম্বার অনেক কমে যাবে। তোমাকে এখন দিলাম দশে পাঁচ। ঠিক আছে?
ইমন বলল, না ঠিক নেই।
ঠিক নেই কেন?
ইমন শান্ত গলায় বলল, আমার উত্তর শুদ্ধ হয়েছে। তুমি সেইভাবে আমাকে নাম্বার দেবে। উত্তর কীভাবে দিয়েছি সেটা চিন্তা করে নাম্বার দেবে না।
তোমার যুক্তি গ্রাহ্য। গ্রাহ্য মানে জানো? গ্রাহ্য মানে হলো গ্রহণযোগ্য। Accepted. এখন তুমিই বলো দশে তোমাকে কত দিতে হবে?
আগে যা দিয়েছ তাই। দশে এগারো।
ঠিক আছে তাই দিলাম। দশে এগারো।
থ্যাংক য়্যু।
শওকতের পায়ের কাছে বড় লাল রঙের একটা স্যুটকেস। হাতে ইমনের সবুজ রঙের ব্যাক প্যাক। শওকত ব্যাক প্যাক পায়ের কাছে রেখে বাঁ হাত দিয়ে ইমনের কোমর চেপে ধরেছে। কিছুটা জায়গা রাস্তা খুব খারাপ। খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। অথচ মাত্র এক সপ্তাহ আগেই নতুন পিচ ঢেলে রাস্তা ঠিক করা হয়েছিল।
শওকত বলল, এ জার্নি বাই রিকশা কেমন লাগছে?
ভালো লাগছে।
এই ঝাঁকুনি তো ভালো লাগার মতো কিছু না। ভালো লাগছে কেন?
ইমন বলল, আমি জানি না কেন ভালো লাগছে।
শওকত বলল, সবচে ভালো রিকশা ভ্রমণের একটা ব্যবস্থা আমি করব। যাতে তুমি যতদিন বেঁচে থাক, ততদিন যেন এই ভ্রমণের কথা তোমার মনে থাকে।
সেটা কেমন?
আমি কী করব শোন, প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে খোলা রিকশায় তোমাকে নিয়ে বের হব। রাস্তায় পানি জমে যাবে। পানির ভেতর দিয়ে রিকশা চলবে। তোমার কাছে মনে হবে, তুমি চাক্কা লাগানো নৌকায় চড়েছ। মাথার উপর ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়বে। ঠাণ্ডা বাতাসে তোমার শরীর শিরশির করবে।
ইমন মুগ্ধ গলায় বলল, I think I will like that.
তোমার কি ঠাণ্ডার ধাত আছে?
ঠাণ্ডার ধাত মানে কী?
ঠাণ্ডার ধাত হলো অল্পতেই যাদের ঠাণ্ডা লাগে। একটা আইসক্রিম খেলে গলা ফুলে গেল। মাথায় তিন ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল অমনি জ্বর, কাশি। আছে ঠাণ্ডার ধাত?
আছে।
থাকলে থাকুক, আমরা বৃষ্টিতে ভিজবই।
Ok.
ইমন লক্ষ করল, তার কেন জানি কাদতে ইচ্ছা করছে। গলা ভার ভার লাগছে। গলার কাছে কী যেন আটকে আছে। অথচ কাঁদার মতো কোনো ঘটনা ঘটে নি। বাবার সঙ্গে রিকশা করে যেতে তার খুবই ভালো লাগছে। আবার একই সঙ্গে কান্নাও পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ ভিজে যাবে। কান্না বন্ধ করার সহজ বুদ্ধি হলো, কঠিন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা। তেমন কোনো কঠিন বিষয় ইমনের মাথায় আসছে না।
শওকত বলল, চুপ করে আছ কেন? কথা বলো।
ইমন কোনো কথা বলল না। চুপ করেই রইল। শওকত তাকিয়ে দেখল, ছেলের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সে কিছু বলল না।