- বইয়ের নামঃ যদিও সন্ধ্যা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
জংলামতো ছায়াময় জায়গা
জংলামতো ছায়াময় জায়গা। আধো আলো আধো অন্ধকারে দুটা কচুগাছ। একটা কচুগাছে রোদ এসে পড়েছে। তির্যক আলো পড়ার জন্যেই হয়তো কচুপাতার সবুজ রঙ ঝলমল করছে। দুটি কচুপাতাতেই শিশির জমে আছে। চিকমিক করছে শিশির।
শওকতের ইচ্ছা করছে কচুপাতায় আস্তে করে টোকা দিতে। যাতে শিশিরবিন্দুগুলি গড়িয়ে পড়ে। ঝরে পড়ছে শিশির দেখতেও খুব সুন্দর লাগার কথা। কাজটা করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দৃশ্যটা বাস্তব না। জলরঙে আঁকা ছবি। ছবির পাতায় টোকা দিয়ে শিশির ঝরানো যাবে না। ছবিতে সময় স্থির হয়ে থাকে। সময়কে আটকে দিতে পারেন শুধুমাত্র চিত্রকররা। কার কথা যেন? ও আচ্ছা, ব্রিটিশ, পেইন্টার কনস্টবলের কথা। ইনি সাত বছর ধরে এঁকেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ছবি— Landscape with trees and a distant mansion.
এই ছবিটা কনস্টবল সাহেবকে দেখাতে পারলে হতো। শওকত বলত, আচ্ছা স্যার, আপনার কি ইচ্ছা করছে না কচুপাতায় টোকা দিয়ে শিশিরবিন্দু ঝরিয়ে দিতে?
এই প্রশ্নের উত্তরে কনস্টবল সাহেব তার দিকে কঠিন চোখে তাকাতেন, জবাব দিতেন না। তখন শওকত বলত, স্যার, আপনার তো ডিটেল কাজের দিকে ঝোঁক। এই ছবির ডিটেলের কাজ দেখেছেন? আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন জলরঙে ডিটেলের কাজ করা খুবই কঠিন। ছবির গ্রান্ডমাস্টাররা এই কারণেই জলরঙ পছন্দ করতেন না।
শওকত প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। নতুন প্যাকেট। এখনো খোলা হয় নি। এই বাড়িতে সিগারেট খাওয়া যায় কি-না সে জানে না। আজকাল প্রায় বাড়িতেই সিগারেট ধরানো নিষিদ্ধ। এটা একটা নতুন ফ্যাশন। সিগারেট ঠোঁটে দেয়ামাত্র ঘরের কত্রী চোখ কপালে তুলে বলবেন—ভাই, এই বাড়ি স্মোক-ফ্রি। সিগারেট খাবার জন্যে বারান্দায় জায়গা করা আছে। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
এ বাড়ির ড্রয়িংরুমের সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে। এ বাড়িটাও স্মোকফ্রি। শওকত যেখানে বসে আছে, তার পাশেই সাইড টেবিলে অবশ্যি একটা এসট্রে রাখা আছে। ক্রিস্টালের তৈরি এসট্টে। এত সুন্দর যে সেখানে সিগারেটের ছাই ফেলতে হলে বুকের কলিজা বড় হওয়া লাগে। দেখে মনে হচ্ছে না কেউ এখানে কোনোদিন ছাই ফেলেছে।
ড্রয়িংরুম ফাঁকা। সিগারেট ধরানো মাত্র কেউ বলবে না এই বাড়ি স্মোক ফ্রি। তারপরেও শওকত মন স্থির করতে পারছে না। সে বসে আছে পনের মিনিটের মতো হয়েছে। এর মধ্যে একজন বাবুর্চি টাইপ লোক শান্তিনিকেতনি ভাষায় বলেছে, আপনাকে চা দেব? শওকত বলেছে, হ্যাঁ। সেই চা এখনো আসে নি। একা একা বসে থাকতে শওকতের খুব যে খারাপ লাগছে তা না। অতি বড়লোকদের ড্রয়িংরুমে এমন সব জিনিস থাকে যা দেখে সুন্দর সময় কাটানো যায়।
কোনো কোনো বাড়ির ড্রয়িংরুম মিউজিয়ামের মতো সাজানো থাকে; মুখোশ, গালার তৈরি মূর্তি, পাথরের মূর্তি, কষ্টিপাথরের মূর্তি, লাফিং বুদ্ধা। আবার কিছু ড্রয়িংরুম হয় আর্ট গ্যালারি। বিখ্যাত সব পেইন্টারদের ছবি। যামিনী রায়, নন্দলাল বসু, ফিদা মকবুল হোসেন। দেশীয় পেইন্টারদের মধ্যে জয়নুল আবেদীন ছাড়া আর কেউ পাত্তা পান না।
আবার কিছু কিছু বাড়ির ড্রয়িংরুম দেখে মনে হয়— ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে ঢুকে পড়া হয়েছে। পৃথিবীর নানান দেশের নানান জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো। গৃহকর্তা যেসব দেশ ভ্রমণ করেছেন, সেসব দেশের কিছু না কিছু জিনিস কিনেছেন। এস্কিমোদের মাথার ফার টুপি থেকে ইফেল টাওয়ারের ক্রিস্টাল রেপ্লিকা। কিছুই বাদ নেই।
এই বাড়ির ড্রয়িংরুমের চরিত্রটা শওকতের কাছে এখনো পরিষ্কার হয় নি। দর্শনীয় একটা ঝাড়বাতি আছে। যদিও ঝাড়বাতির চল এখন উঠে গেছে। নতুন কনসেপ্টে ড্রয়িংরুম হতে হবে সিম্পল, ঘরোয়া। ইংরেজি ভাষায় কমফর্টবেল এন্ড কোজি। আধুনিক ড্রয়িংরুমে দুটার বেশি পেইন্টিং থাকবে না। এ বাড়িতে আছে কচুপাতার উপর শিশির।
তিনটা ফ্যামিলি ছবি থাকতে পারে। তিনটার বেশি কখনো না। এই ড্রয়িংরুমে তিনটাই আছে।
স্যার, আপনার চা।
শওকত তাকাল। বাবুর্চি টাইপ লোকটা শেষপর্যন্ত চা এনেছে। এককাপ চা। চায়ের সঙ্গে পিরিচ দিয়ে ঢাকা ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি। পানিটা যে খুবই ঠাণ্ডা সেটা বুঝা যাচ্ছে গ্লাসের গায়ে জমা বিন্দু বিন্দু পানির কণা দেখে। শওকতের এমনিতে কখনোই পানির তৃষ্ণা হয় না। শুধু ঠাণ্ডা পানির গ্লাস দেখলে প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়ে যায়। শওকত পানি খেতে খেতে বলল, আপনার নাম কী?
লোকটি হাসিমুখে বলল, স্যার আমার নাম আকবর। এই ড্রয়িংরুমে কি সিগারেট খাবার অনুমতি আছে?
অবশ্যই আছে। আপনার কাছে সিগারেট আছে? না-কি আনিয়ে দেব?
সিগারেট-ম্যাচ সবই আমার সঙ্গে আছে। আমি যে এসেছি আপনার ম্যাডাম কি তা জানেন?
জি জানেন। উনি গোসলে ঢুকেছেন বলে দেরি হচ্ছে। আপনি চা খেতে খেতে চলে আসবেন। স্যার, আপনাকে কি খবরের কাগজ দেব?
দরকার নেই। এ বাড়িতে আপনার কাজটা কী?
আমি কেয়ারটেকার। সব ধরনের কাজই কিছু কিছু করতে হয়।
আপনার ভাষা খুবই সুন্দর। দেশের বাড়ি কোথায়?
যশোহর।
আপনি কি আমাকে আরেক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাওয়াতে পারবেন?
অবশ্যই পারব।
শওকত সিগারেট ধরাল। চায়ের কাপে চুমুক দিল। বড়লোকদের বাড়ির চা কেন জানি সবসময়ই কিছুটা ঠাণ্ডা হয়। এই চা ঠাণ্ডা না, গরম এবং খেতেও ভালো। শওকত আবারো তাকাল কচুপাতার ছবির দিকে। আলো-ছায়ার খেলাটা এত সুন্দর এসেছে! এই শিল্পীকে মন খুলে অভিনন্দন জানাতে পারলে ভালো হতো। সেটা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ এই ছবি তারই আঁকা। নিজেকে নিজে ধন্যবাদ দেয়ার চল সমাজে নেই।