খুব অল্প সময়ের জন্যে কলিংবেল বাজল। নিশ্চয়ই নিশাত আপা। নিশাত আপা কলিংবেলটা ছুঁয়েই হাত সরিয়ে নেন। ঘরের ভেতর থেকে কে কে বলে চেচিয়ে মরলেও সাড়া দেন না। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আরেক বার বেল টেপেন।
পুষ্প দ্বিতীয় বার বেল টেপার জন্যে অপেক্ষা করল না। উঠে দরজা খুলে দিল। নিশাত নয়, মিজান দাঁড়িয়ে। চোখে সানগ্লাস। চুল উচ্চখুষ্ক।
কি, ভেতরে আসতে বলবেন, না বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব?
ভাই আসুন।
আমি হচ্ছি অসময়ের অতিথি। আজো দেখি মেঝেতে শয্যা পেতেছেন। মেঝেতে ঘুমোতে বুঝি খুব আরাম?
পুষ্প হাসল। মিজান বলল, আমিও এক দিন শুয়ে দেখব। চট করে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি আনুন। হিম-শীতল।
খুব ঠাণ্ডা তো হবে না।
ও আচ্ছা-আচ্ছা, মনে থাকে না। তা হলে চা। আপনার পুত্র দেখি আজ এখানেই আছে। কেউ নিয়ে যায় নি?
জ্বি-না।
সুন্দর ছেলে আপনার। মার বিউটি পেয়েছে। বাবার মতো হয় নি—এটা একটা ভালো ব্যাপার। হা হা হ্যাঁ। রাগ করলেন না তো ভাবি?
জ্বি-না। রাগ করব কেন?
বসতেও তো বলছেন না।
বসুন। আমি চা নিয়ে আসছি।
দেরি করবেন না, আমার হাতে সময় বেশি নেই।
পুষ্প চা বানিয়ে নিয়ে এল। লোকটির উপর আজ আর প্রথম দিনের মতত রাগ হচ্ছে না। কত ঝামেলা করে সুন্দর একটা বাসা জোগাড় করেছে। আজকালকার যুগে কে আর বন্ধুদের জন্যে কিছু করে। কেউ করে না।
চিনি হয়েছে?
মিজান চুমুক না-দিয়েই বলল, হয়েছে। যতটুকু মিষ্টি হবার কথা তার চেয়েও বেশি হয়েছে। ভাবি আপনি বসুন। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
পুষ্প বসল। মিজান বলল, মাথায় এমন ঘোমটা দিয়ে বসেছেন কেন? আমাকে লজ্জা করছেন নাকি?
জ্বি-না।
গুড, লজ্জা করবেন না। ঘোমটা ফেলে দিন। এই তো চমৎকার, ইন্দ্রাণীর মতো লাগছে। বুঝলেন ভাবি, খুব সুন্দরী যে-সব তরুণীরা আছে, তাদের বিয়ে করা উচিত নয়। মোটেই উচিত নয়।
উচিত নয় কেন?
সৌন্দর্য হচ্ছে সবার জন্য, এক জন পুরুষের জন্য নয়। প্রাচীন মিশরের একটা নিয়ম কী ছিল জানেন? সবচেয়ে সুন্দরী রমণীদের নাচেগানে শিক্ষিত করে তোলা হত। তাদেরকে আলাদা করে রাখা হত সব পুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা? এরা হত জনপদবধূ। Lady of the town.
পুষ্প হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। এই মানুষটি এইসব কথা বলছে কেন?
ভাবি।
জ্বি।
শুনলাম বাসা নাকি আপনাদের পছন্দ হয়েছে।
জ্বি, হয়েছে। খুব সুন্দর বাসা।
ধন্যবাদ তো দিলেন না।
ধন্যবাদ।
শুধু ধন্যবাদ! এর বেশি কিছু না? আপনি দেখছি হার্টলেস।
পুষ্প কী বলবে ভেবে পেল না। বাবুর দিকে তাকাল। বাবুর উঠে পড়ার সময় হয়েছে। এক্ষুণি হয়তো উঠবে। সে মনে-মনে বলল, বাবু ওঠ।
ভাবি।
জ্বি।
এবার তা হলে বিদায় দিন।
আবার আসবেন।
নিশ্চয়ই আসব। যাই তা হলে? যে-জন্য এসেছিলাম তা অবশ্যি এখনো বলা হয়। নি। যদি অনুমতি দেন তা হলে বলি।
পুষ্প ক্ষীণ স্বরে বলল, বলুন।
ভয়ে বলব না নিৰ্ভয়ে বলব?
পুষ্পের ইচ্ছা করছে লোকটাকে কিছু কড়া কথা বলতে। সে যা করছে তাকে ঠিক ঠাট্টা হিসেবে সে নিতে পারছে না। এইভাবে কেউ ঠাট্টা করে না। ঠাট্টা বোঝর মতো বয়স তার হয়েছে।
এই রকম ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন কেন ভাবি? আপনার কি ধারণা আমি আপনাকে ভয়ানক কিছু বলব? অবসিন কিছু?
জ্বি-না, তা কেন বলবেন?
বলতেও তত পারি?
হা হা হ্যাঁ।
হাসির শব্দে পল্টুর ঘুম ভেঙে গেল। অপরিচিত লোকটিকে সে কিছুক্ষণ দেখল। কেঁদে ওঠার উপক্রম করেই মত বদলাল। হাসিমুখে হামাগুড়ি দিয়ে মার কাছে আসতে লাগল।
মিজান উঠে দাঁড়াল। হালকা গলায় বলল, চলি ভাবি, আমি যে এসেছিলাম এটা রকিবকে বলবেন না। কি না কি মনে করে বসবে। স্বামীরা আবার খুব ঈর্ষাপরায়ণ হয়।
মিজান চলে যাবার কিছুক্ষণ পরই রকিব এসে পড়ল। রকিবের মুখ হাসি-হাসি। এরকম হাসিমুখ তার সচরাচর থাকে না। খুশির কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই হয়েছে।
মিজান এসেছিল নাকি?
হ্যাঁ।
খুব জ্বালিয়ে গেছে না? হা হা হ্যাঁ। ব্যাটা প্ল্যান করে এসেছে। আমার সঙ্গে পঞ্চাশ টাকা বাজি—তোমাকে কাঁদিয়ে দেবে। কাঁদাতে পেরেছে? কেঁদেছিলে? আমি বললাম, কাঁদাতে পারবেনা রে বাবা। শক্তচিজ। সে বললপারবেই। তারপর বল রেজাল্ট কি? পাস না ফেল?
পুষ্প জবাব দিল না। তাকিয়ে রইল।
মিজান এই রকমই। কলেজ লাইফ থেকে দেখছি। দারুণ ফুর্তিবাজ ছোকরা। কাপড় পর। কুইক, ভেরি কুইক। সময় নেই।
কোথায় যাবে?
মিজান কিছু বলে নি?
না।
আরে, এই ব্যাটা তোমার কাছে এসেছে কেন? তার গাড়ি রেখে যাওয়ার জন্যে। গাড়ি রেখে গেছে। বারান্দায় গিয়ে দেখ, ক্ৰীম কালারের গাড়ি উইথ ড্রাইভার।
গাড়ি দিয়ে কী হবে?
ঘরব। চিড়িয়াখানাফিডিয়াখানা যাব। পন্ট নাকি গাড়ি পছন্দ করে। যাও যাও, দেরি করবে না। দু-এক জন আত্মীয়স্বজনের বাসায়ও যাওয়া যায়, কি বল। গাড়ি যখন পাওয়া গেছে বড়লোক কায়দা করা যাক। রাত নটা পর্যন্ত গাড়ি রাখা যাবে।
বড়লোক কায়দা তারা ভালই করল। চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, বলধা গার্ডেন সব এক দিনে। পল্টু মহা খুশি জে জে জে জে করে নিজের মনে গান গেয়ে যাচ্ছে। খোলা জানালা দিয়ে মাথা বের করবার চেষ্টা করছে। হাসতে-হাসতে ভেঙে পড়ছে। রকিবও খুশি। সে পাঁচটা বেনসন সিগারেট কিনেছে। গাড়ির সীটে হেলান দিয়ে সিগারেট খাবার মজাই নাকি আলাদা। এর মধ্যে চারটা সিগারেট শেষ। মাঝেমাঝে ড্রাইভারের সঙ্গে কথাও বলছে।