তা কিছুটা অবশ্যি করছ। তোমার যখন এত শখ–লেট আস হ্যাভ অ্যা বেবি। ওটা তো তেমন কঠিন কিছু না।
নিশাত কিছু বলল না।
জহির বলল, আমি অবশ্যি এখনন আমাদের অরিজিন্যাল প্ল্যানে বিশ্বাসী। প্রথম পাঁচ বছর ঝামেলাহীন জীবন। দু জন শুধু থাকব, ঘুরে বেড়াব। এক জন অন্য জনকে ভালোমতো জানব……….
এখনন আমাকে জানতে পার নি?
না।
কোন জিনিসটা জানবার বাকি আছে?
তোমার মুডের ব্যাপারটা জানি না। অতি দ্রুত তোমার মুড পাল্টায়। কখন কি জন্যে পাল্টায় সেটা ঠিক ধরতে পারি না। কিছুটা রহস্য থেকেই যায়।
কিছু রহস্য থাকাই তো ভালো। জীবন থেকে রহস্য চলে গেলে তো মুশকিল।
জহির বলল, এক কাপ কফি খাওয়া যেতে পারে।
নিশাত রান্নাঘরে ঢুকে পারকুলেটর চালু করল। আর ঠিক তখন কলিংবেল বাজল। পুষ্প এসেছে হয়ত। নিশাত নড়ল না। জহির দরজা খুলে দেবে। ঠিক এই মুহূর্তে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। সে এসে তার বাচ্চা নিয়ে চলে যাক। জহির ঠিকই বলেছে, তার মুড খুব দ্রুত পাল্টায়। এত দ্রুত যে তার সঙ্গে তাল রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে।
আপা।
এস পুষ্প।
বাবুকে নিতে এলাম। আমরা আবার বাড়ি দেখতে চলে গিয়েছিলাম।
তাই নাকি? জ্বি। বাসা পছন্দ করে এসেছি। হাফ বিল্ডিং, উপরে টিনের ছাদ।
টিনের ছাদও বর্ষাকালে খুব মজা হবে। ঝুমঝম করে টিনের ছাদে বৃষ্টি হবে। কফি খাবে পুষ্প?
খাব। আমরা আজ বাইরে খেয়ে এসেছি। ও বলল, চল বাইরে খাই।
খুব ভালো করেছ।
আবার কি মনে করে যেন আমাকে একটা শাড়ি কিনে দিল। টাকাপয়সার এ-রকম টানাটানি, এর মধ্যে আবার হঠাৎ শাড়ি। শাড়িটা দেখবেন আপা? নিয়ে আসি?
আন।
পুষ্প কফির কাপ নামিয়ে ঝড়ের মতো ছুটে গেল। যাবার সময় বাবুকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। জহির পাশেই ছিল। জহিরের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাদের নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত করেছে।
জহির হালকা গলায় বলল, আমাকে কোনো বিরক্ত করে নি। নিশাতকে হয়তো বা করেছে। আমি ঠিক জানি না। জহিরের মনে হল দরে থেকে মেয়েটাকে গেঁয়ো মনে হলেও মেয়েটা গেঁয়ো নয়। তার মধ্যে স্বাভাবিক একটা সহজ ভাব আছে, এবং মেয়েটি রূপবতী। নিশাতও রূপবতী, তবে নিশাতের রূপে কেমন একটা ঠাণ্ডা ভাব আছে। এর মধ্যে সেই শীতল ভাবটা নেই।
নিশাত পুষ্পের জন্য অপেক্ষা করছে। দু চুমুক দিয়ে সে কফির কাপ নামিয়ে রেখে গেছে। কফি ঠাণ্ডা হচ্ছে। কাপটা কি একটা পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখবে?
ঐ মহিলা তোমাকে ভাবি না ডেকে আপা ডাকে কেন?
জানি না কেন।
মেয়েটিকে কথাবার্তায় খুব গেঁয়ো কিন্তু মনে হয় না।
গেয়ো বলতে তুমি কী মীন করছ?
রাস্টিক। রিফাইনমেন্টের অভাব। আরো ব্যাখ্যা চাও?
নিশাত কিছু বলল না।
দাঁড়াও, আরেকটা ব্যাখ্যা দিই। মনে কর একটা প্লেটে লাল টুকটুকে একটা আপেল। এক জন সেই আপেলের সৌন্দর্য প্রথম দেখবে, অন্য জন আপেলটাকে দেখবে শুধুই খাদ্য হিসেবে।
আপা আসব?
এস, তোমার কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
আমি কফি খাব না আপা, ভালো লাগে না।
পুষ্পের হাতে শাড়ির প্যাকেট। সে অস্বস্তি বোধ করছে। আড়চোখে তাকাচ্ছে। জহিরের দিকে। এই মানুষটির সামনে শাড়ির প্যাকেট খোলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। নিশাত জহিরের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি দয়া করে পাশের ঘরে যাবে? আমরা একটা মেয়েলি ব্যাপার নিয়ে আলাপ করব, তোমার হয়ত ভালো লাগবে না।
জহির পাশের ঘরে চলে গেল। দরজা ভিড়িয়ে দিল। নিশাত নিজেই শাড়ির প্যাকেট খুলছে।
বাহ্, চমৎকার তো! বাংলাদেশে শাড়ির ডিজাইন অনেক উন্নত হয়েছে। সিম্পলের মধ্যে এরা ভালো জিনিস করছে।
আপনার পছন্দ হয়েছে আপা?
খুব পছন্দ হয়েছে। চমৎকার! নীল ব্যাকগ্রাউণ্ডে সাদা ফুল থাকলে মনে হয় আরো সুন্দর হত। আকাশে তারা ফুটে আছে, এরকম একটা এফেক্ট পাওয়া যেত। আমি বেশ কটা শাড়ির ডিজাইন জমা দিয়েছিলাম বিসিকে। একবার খোঁজ নিতে হবে ওরা নিল কি না।
আপনি শাড়ির ডিজাইন জমা দিয়েছিলেন? ও মা, কী বলছেন।
কেন জমা দেব না। আমি কমার্শিয়াল আর্টের ছাত্রী। একদিন তোমাকে আমার আঁকা ছবি দেখাব।
পুষ্প মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। নিশাত সেই মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আরেক বার মনে-মনে বলল, কী সুন্দর মেয়েটি।
পুষ্প ঠাণ্ডা মেঝেতে হাত-পা এলিয়ে পড়ে আছে
পুষ্প ঠাণ্ডা মেঝেতে হাত-পা এলিয়ে পড়ে আছে। তার চমৎকার লাগছে। দুপুরবেলার এই সময়টার মধ্যে কোনট-একটা রহস্য আছে। সময়টাকে খুব আপন মনে হয়। সারা শরীরে থাকে ঘুম-ঘুম আলস্য। ঘুমাতে ইচ্ছা করে, আবার জেগে থাকতেও ইচ্ছা করে।
বাবু ঘুমাচ্ছে। তার ঘুমবার ভঙ্গিটা খুব বিশ্ৰী। হাঁ করে ঘুমায়। আজো হাঁ করে আছে। পুষ্প খুব সাবধানে মুখের হাঁ বন্ধ করে দিল। অভ্যাস হয়ে গেলে মুশকিল। বড় হয়েও যদি হাঁ করে ঘুমায়, তা হলে তো সর্বনাশ!
বাবু ঘুমের মধ্যেই হাত দিয়ে মাকে একটা ধাক্কা দিল। পুষ্প গম্ভীর গলায় বলল, এসব কী হচ্ছে? মার গায়ে হাত তোলা হচ্ছে। খুব খারাপ। আমি কিন্তু রাগ করলাম। তোমার সঙ্গে আর কোনো কথা হবে না। না না না।
ঘুমন্ত ছেলের সঙ্গে পুষ্পমাঝে-মাঝে সময় ধরে একতরফা কথাবার্তা বলে। টেনেটেনে অনেকটা গান গাওয়ার ভঙ্গিতে। শেষের দিকে কথাগুলো বলা হয় মিল দিয়ে। দিয়ে।
খোকন সোনা
কথা বলে না,
শুধু ঘুমায়, মাথা নাড়ায়
আবার হাসে, ভালবাসে।
এই ব্যাপারগুলি ছেলে জেগে থাকা অবস্থায় বা ছেলের বাবার উপস্থিতিতে পুল্প কখনন করে না। তার খুব লজ্জা লাগে। এই বাবু তার নিজের, অন্য কারোর নয়—এর মধ্যেও যেন খানিক লজ্জা আছে। এই বাবু অন্য কারোর হলে সে বোধহয় আরো বেশি ভালবাসতে পারত।