কি জন্যে এসেছি সেটা আগে বলে ফেলি, নয়ত কি না কি ভাববেন কে জানে। রকিব বাড়ির কথা বলছিল। সোবহানবাগে দুটা বাসা আছে। একটা হাফ বিল্ডিং, উপরে টিন। দুই কামরা, গ্যাস, পানি, ইলেকট্রিসিটিসবই আছে। ভাড়া তের শ। আরেকটা আছে তিন তলার ফ্ল্যাট। ভাড়া সতের শ। মালিকের সঙ্গে আমার চেনাজানা আছে। কিছু কমাবে। অ্যাডভান্স লাগবে না। রকিবকে নিয়ে দেখে এসে মনস্থির করুন। বাহ্, ফাসক্লাস চা হয়েছে।
আপনি দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন কেন, বসুন।
ভাবি মনে হচ্ছে একটু স্বস্তি পেলেন। এখন ভাবছেন লোকটা রঙ্গ-তামাশা করতে আসে নি। ঠিক করে বলুন তো, তাই ভাবছিলেন না?
পুষ্প ফ্যাকাসেভাবে বলল, জ্বি-না।
না বললেও বিশ্বাস করব না। চোখমুখ কেমন সাদা হয়ে গেছে। ভাবি চলি।
এখুনি যাবেন?
যদি যেতে নিষেধ করেন যাব না। সুন্দরী মহিলার নিষেধ অগ্রাহ্য করব এত বড় বোকা আমি না। তবে আজ না ভাবি। ড্রাইভারকে আজ সকাল-সকাল ছেড়ে দিতে হবে। চলি, কেমন? ও আচ্ছা, বাড়ির ঠিকানা তো দেওয়া হয় নি। কাগজ-কলম আনুন।
মিজান ঠিকানা লিখে সত্যি-সত্যি চলে গেল। যাবার আগে বলল, বেয়াদপি হলে নিজগুণে ক্ষমা করবেন ভাবি। আর রকিবকে আমি খবর দিয়ে দেব যাতে সকালসকাল অফিস থেকে ফেরে। আজই দেখে আসবেন। দেরি করবেন না। বাড়ির খুব ক্রাইসিস।
রকিব পাঁচটার আগেই ফিরল। চা খেয়েই বাড়ি দেখতে বেরুল। সঙ্গে পুষ্প। বাবুকে নিয়ে নিশাত এখনন ফেরে নি। রকিব বিরক্ত মুখে বলল, কার-না-কার কাছে বাচ্চা দিয়ে দাও!
আগ্রহ করে নিতে চাইলেন।
আগ্রহ করে কেউ বাচ্চা নিতে চাইলেই বাচ্চা দিয়ে দেবে? চেন না, জান না!
চিনব না কেন? বাবু খুব খুশি হয়ে গেছে। গাড়িতে চড়তে খুব পছন্দ করে। গাড়ি নিয়ে তো কোথাও যাওয়া হয় না।
গাড়ি নিয়ে যাওয়া একটা বড় কথা নাকি? মিজানকে বললেই গোটা দিনের জন্য গাড়ি দিয়ে দেবে। খুবই মাই ডিয়ার লোক। বন্ধুদের জন্য খুব ফিলিং। দেখ না নিজে কেমন বাড়ি খুঁজে বের করল। হার্ট অব দা টাউনে।
কেমন বাড়ি কে জানে।
বাড়ি ভালোই হবে। ওর রুচি ভালো। এলেবেলে জিনিস দেখবে না।
দুটি বাড়ির মধ্যে টিনের বাড়িটা পুষ্পের খুব মনে ধরল। কী ছিমছাম। দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সামনে অল্প খানিকটা জায়গা। এর মধ্যে দুটা কামিনী গাছ, একটা পেঁপে গাছ এবং একটা কাঁঠাল গাছ। বড়-বড় কাঁঠাল ধরে আছে। রান্নাঘরের পাশে ছোট একটা স্টোররুম আছে। বাড়ির মেঝে কালো সিমেন্টের। তাকালেই কেমন ঠাণ্ডাঠাণ্ডা ভাব আসে। রকিব বলল, মন্দ নয়, কী বল? নেওয়া যায় না?
খুব নেওয়া যায়। সুন্দর বাড়ি। খুব সুন্দর।
গরমে কষ্ট পাবে। টিনের ছাদ।
টিনের ছাদের বাড়ি রাতের বেলা আরাম হয়। ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তা ছাড়া কেমন। সুন্দর বারান্দা। তুমি বিকালে বরান্দায় বসে চা খাবে।
রকিব শব্দ করে হেসে উঠল।
হাসছ কেন?
বারান্দায় চা খাওয়ার মধ্যে কী আছে?
নিশাত আপারা বারান্দায় চা খায়। দেখতে কী ভালো লাগে।
বারান্দা তো তোমারও আছে, তুমি বসে খেলেই পার।
মেঝেতে বসে-বসে খাব? আমাদের কি এঁদের মতো চেয়ার-টেবিল আছে?
হবে, সব হবে। ধীরে ধীরে হবে। আগামী জুন মাস নাগাদ একটা প্রমোশনের কথা আছে।
সত্যি?
হুঁ। তেলাতেলির ব্যাপার আছে। ঐটা করতে হবে ভালোমতো।
কর। সবাই যখন করছে।
করব তো বটেই। তৈল কাহাকে বলে, কত প্ৰকার ও কী কী এখন ব্যাটারা বুঝবে।
রকিব সিগারেট ধরিয়ে মহা সুখে টানতে লাগল। বোঝাই যাচ্ছে বাড়ি তারও পছন্দ হয়েছে। পুষ্প মনে-মনে বাড়ি সাজাতেও শুরু করেছে। সুন্দর করে পর্দা দেবে। কয়েকটা বেতের চেয়ার কিনবে। বাসনপত্র কিনবে। জমানো টাকার কিছুটা সে খরচ করবে। একটা ফ্যান কিনতে হবে। সিলিং ফ্যানের কী রকম দাম কে জানে। বলতে গেলে এই প্রথম তার নিজের সংসার। বিয়ের পর দু বছর কাটল শ্বশুরের সঙ্গে ময়মনসিংহে। রকিব আসত সপ্তাহে-সপ্তাহে। কী কষ্ট বেচারার। খাওয়ার কষ্ট। একাএকা থাকার কষ্ট। ঢাকায় ফিরে যাবার সময় কী যে মন-খারাপ করত।
পুষ্প।
কি?
বাইরে খাবে?
কোথায়?
কোনো একটা রেস্তোরাঁয়?
কী যে তুমি বল।
চল যাই। মাঝেমধ্যে একটু বাইরে খাওয়া দরকার। রোজ-রোজ ঘরের খাওয়া একঘেয়ে হয়ে যায়। চল, নানরুটি আর কাবাব খাই।
মাত্র তো সন্ধ্যা! এখন নানরুটি আর কাবাব খাবে?
নিউ মার্কেটে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি, তারপর না-হয় যাব।
আর বাবু? বাবুর কী হবে?
কী আর হবে? যারা নিয়েছে তারা দেখবে। মজা বুঝক। ভবিষ্যতে তা হলে আর নেবে না।
নিউ মার্কেটে তারা বেশ খানিকক্ষণ ধুরল। ঠাণ্ডা পেপসি খেল। পুষ্পকে খুবই অবাক করে দিয়ে রকিব একটা শাড়ি কিনে ফেলল। নীল ফুলের ছাপ দেওয়া সুতি শাড়ি। এতেই আনন্দে পুষ্পের চোখে পানি এসে যাবার মত হল। পুষ্প বলল, বাবুর জন্যে কিছু কিনবে না? কোন খেলনাটেলনা?
আরে, ও খেলনার কী বোঝে। খেলনার সময় হোক, কিনে দেব।
নিশাত ঘুমন্ত পল্টুকে তার বিছানায় শুইয়েছে। জহির বলল, নিচে একটা অয়েলক্লথ দরকার না? আমার তো মনে হচ্ছে বিছানা ভাসিয়ে দেবে।
নিশাত বলল, অয়েলথ এখন পাব কোথায়?
ওর বাবা-মার আক্কেলটা দেখ না। রাত নটা বাজে, এখনো ট্রেস নেই।
দুজনে মিলে বেড়াচ্ছে। সুযোগ হয় না বোধহয়। তোমাকে কফি করে দেব?
না।
খুব কঠিন স্বরে না বললে। তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?
রাগ করব কেন?
এই যে পরের বাচ্চা নিয়ে আদিখ্যেতা করছি।