পুষ্প।
বল।
প্রতি মাসে একটা-দুটা প্রাইজবন্ড কিনে রাখব, বুঝলে। লেগে গেলে কেল্লা ফতে। আমাদের অফিসের এক জন দশ হাজার টাকা পেয়ে গেল। হাজার পাঁচেক টাকা সবসময় হাতে থাকা দরকার। কখন কি ঝামেলা হয় কিছুই বলা যায় না।
পুষ্প চুপ করে রইল। এক বার ভাবছিল বলবে, আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা আছে। আমার নানি দিয়েছেন। বলল না। নানিজান হজ্বে যাবার সময় তাদের তিন বোনের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার করে টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নিজস্ব সম্পত্তির পুরোটাই বিলি-ব্যবস্থা করে গেলেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল হজ্ব করে তিনি ফিরবেন না। ইশতেখারা করে নাকি এই খবর জেনেছেন। হজ্ব করে তিনি পুরোপুরি সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছেন। এখন একেক ছেলের সংসারে কিছু দিন করে থাকেন আর তাঁদের বিরক্ত করে মারেন। কারো সঙ্গেই তাঁর বনে না। পুষ্পের খুব ইচ্ছা নানিজানকে এ–বাড়িতে এনে কিছু দিন রাখে। সাহসে কুলায় না। কে জানে এসেই যদি নাতজামাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করেন। তা হলে বড় বিশ্রী ব্যাপার হবে।
রকিব মশারির ভেতর এসে ঢুকল। পুষ্প বলল, বাতি নেভালে না? বাতি নিভিয়ে আস।
একটু পরে নেব।
পুষ্পের লজ্জা করতে লাগল। রকিবের বাতি না-নিভিয়ে মশারির ভেতর ঢোকার অন্য অর্থ আছে। পুষ্প খুব সাবধানে তার ছেলের মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে দিল। সে যদি জেগে ওঠে বড় লজ্জার ব্যাপার হবে। পুষ্প ক্ষীণ স্বরে বলল আমি বাতি নিভিয়ে দিয়ে আসি?
উঁহু। অন্ধকারে আমার ভালো লাগে না।
বাবু উঠে যাবে।
উঠবে না।
রকিব পুষ্পকে কাছে টেনে নিল। তার মুখে সিগারেটের কড়া গন্ধ। অন্য সময় এই গন্ধে পুষ্পের বমি আসে। এখন আসছে না। বরং ভালো লাগছে। রকিব কানের কাছে মুখ নিয়ে গাঢ় আদরের কথা বলছে। এই সময়ের আদরের কথার আসলে তেমন গুরুত্ব নেই, তবু পুষ্পের শুনতে ভালো লাগে। তারও অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে বলতে পারে না। লজ্জা লাগে। তবে অর্থহীন কিছু কথাবার্তা এই সময়ে সে বলে। রকিব মন দিয়ে শোনে কি না সে জানে না, তবে প্রতিটি কথারই উত্তর দেয়।
পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা হল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, অনেক কথা বললেন। চা খাওয়ালেন। বাবুকে খুব আদর করলেন। বিসকিট দিলেন।
ভালোই তো।
ওঁকে দেখতে অহঙ্কারী মনে হয়, কিন্তু আসলে অহঙ্কারী না। বাবুর পল্টু নামটা ওঁর পছন্দ হয় নি।
তাঁদের ছেলেপুলেদের নাম কি?
ছেলেমেয়ে নাই। যখন হবে খুব সুন্দর নাম নিশ্চয়ই রাখবেন।
রাখুক যা ইচ্ছা। আমাদের পর্দুই ভালো। মেয়ে হলে মেয়ের নাম রাখব খুন্তি।
কী নাম রাখবে?
খুন্তি।
কী যে তুমি বল! এই দেখ না বাবু মনে হয় উঠে যাচ্ছে। কেমন পা নাড়াচ্ছে দেখ না।
ও ঘুমাচ্ছে মড়ার মতো। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে উঠবে না।
না না, বুঝতে পারছ না, ওর ঘুম ভাঙার সময় হয়ে গেছে।
উঁহু, হয় নি।
বাতিটা নেভাও, তোমার পায়ে পড়ি।
নেভাব না।
বাবু ঠিক এই সময় জেগে উঠল। বিকট স্বরে কেঁদে উঠল। পুষ্প থমথমে গলায় বলল, এখন শিক্ষা হল তো!
রকিব হাসছে। মনে হচ্ছে তার শিক্ষা এখনো হয় নি।
কলিংবেলটা কী সুন্দর করেই না বাজে
এ-বাড়ির কলিংবেলটা কী সুন্দর করেই না বাজে। যেন একটা পুরনো দেয়াল-ঘড়ি ঢং-ঢং করে বাজছে। প্রথম দু-তিন বার খুব গম্ভীর আওয়াজ, তারপর রিনরিনে আওয়াজ। কলিংবেল বাজলেই এই কারণে পুষ্প অনেকক্ষণ দরজা খোলে না। বাজুক যতক্ষণ ইচ্ছা। কী সুন্দর লাগে শুনতে।
পরপর তিন বার বাজার পর পুষ্প উঠল। অসময়ে কে হতে পারে? দুপুর আড়াইটায় কে আসবে? রকিব নাকি? মাঝে-মাঝে অফিস ফাঁকি দিয়ে সে চলে আসে। বিয়ের পরপর এটা সে বেশি করত, এখন অনেক কমেছে। ছোট ভাইয়া না তো? কল্যাণপুরে ছোট ভাইয়ার বাসা। বির সঙ্গে প্রচণ্ড রকম ঝগড়া হলে সে এরকম সময়-অসময়ে চলে আসে। এক বার রাত বারটার সময় সে পুষ্পের শ্বশুরবাড়ি এসে উপস্থিত। ভাবির সঙ্গে ঝগড়া করে বাসে করে চলে এসেছে। হাতে কোনো টাকাপয়সাও ছিল না।
কে?
ভাবি আমি। অধমের নাম মিজান। অনেকক্ষণ ধরে বেল টিপছি। যদি মর্জি হয় দরজা খুলুন।
পুষ্প লজ্জিত হয়ে দরজা খুলল। তার কাপড় অগোছালো। চুল বাঁধা নেই। এতক্ষণ ঠাণ্ডা মেঝেতে বালিশ এনে শুয়ে ছিল, সেই বালিশ এখনো গড়াচ্ছে।
ঘুম থেকে তুললাম নাকি ভাবি? মেঝেতে শয্যা পেতেছিলেন মনে হচ্ছে।
আসুন, ভেতরে আসুন। ও তো নেই।
সে তো ভাবি জেনেই এসেছি, যাতে খালি বাসায় আপনার সঙ্গে কিছু রঙ্গতামাশা করতে পারি। নাকি আপনার আপত্তি আছে?
পুষ্প কী বলবে ভেবে পেল না। কী অদ্ভুত কথাবার্তা!
ভাবি মনে হচ্ছে আমার কথা বিশ্বাস করে ফেলেছেন? দেখে মনে হচ্ছে ভয় পেয়ে গেছেন। হা হা হ্যাঁ। খুব ঠাণ্ডা দেখে এক গ্লাস পানি দিন তো! বরফ-শীতল পানি।
ঘরে ফ্ৰীজ নেই। পানি খুব ঠাণ্ডা হবে না।
তা হলে চা বানিয়ে দিন। আগুন-গরম চা। চিনি দেবেন না।
একটুও দেব না? চিনি খান না?
যথেষ্টই খাই। তবে আপনার হাতে খাব না। আপনার বানানো চা এমনিতেই মিষ্টি হবে। হা হা হ্যাঁ।
আপনি বসুন, আমি চা বানিয়ে আনছি।
আপনার পুত্র কোথায়?
পাশের ফ্ল্যাটের আপা নিয়ে গেছেন। ওঁর মার বাসায় গেছেন। সন্ধ্যাবেলা আসবেন।
তা হলে শুধু আপনি আর আমি, এই দুজনই আছি? বা ভালোই তো!
পুষ্পের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কী অদ্ভুত কথাবার্তা! সে দ্রুত রান্নাঘরে ঢুকল। তার কেবলই মনে হতে লাগল রকিবের এই বন্ধু রান্নাঘরে উকি দেবে। তা অবশ্যি দিল না। চা বানিয়ে এনে পুষ্প দেখে ফুল স্পীড ফ্যান ছেড়ে তার নিচে মিজান দাঁড়িয়ে।