তা হলে মন খারাপ কেন?
তা তো মা জানি না। মাঝে-মাঝে আমার এরকম হয়। সন্ধ্যাবেলা আসতে বছ। কেন? কি ব্যাপার?
তোর বাবার কাণ্ড! বিরাট এক পাঙ্গাশ মাছ কিনে এনেছে। খুব নাকি ফ্রেশ মাছ। সবাইকে নিয়ে খাবে।
বাবা এমন খাই-খাই করে কেন বল তো মা?
জানি না। একেক বার এমন বিরক্ত লাগে। কিছুক্ষণ আগে ঐ মাছের ছবি তোলা হল।
মা শোন, কয়েকটা সুন্দর দেখে ছেলের নাম দিও তো!
কেন রে?
আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের দেবশিশুর মত একটা ছেলের নাম রেখেছে পল্টু। নামটা পাল্টাব।
তুই এখনো পাগলী হয়েই রইলি।
নিশাতের মা খুব হাসতে লাগলেন। নিশাতও হাসছে। বাচ্চাটির ঘুম ভেঙে গেছে। প্রথমে সে কাঁদবার উপক্রম করেছিল, এখন মত পাল্টে হাসিতে যোগ দিয়েছে। খুব হাসছে।
রাত আটটা বাজতেই পুষ্পর ঘুম পেয়ে যায়
রাত আটটা বাজতেই পুষ্পর ঘুম পেয়ে যায়। নটার দিকে সেই ঘুম এমন হয় যে, সে চোখ মেলে রাখতে পারে না। ঘুম কাটানোর কত চেষ্টা সে করে। কোনোটাই তার বেলায় কাজ করে না। অথচ রকিব রোজ ফিরতে দেরি করে। আজও করছে।
এখন বাজছে নটা তেত্রিশ। আজ বোধহয় দশটাই বাজাবে। পুষ্প চোখে পানি দিয়ে। এল। জিভে লবণ ছোঁয়াল। জিভে লবণ ছোঁয়ালে নাকি ঘুম কাটে। তার কাটছে না। আরো যেন বাড়ছে।
রকিব ফিরল দশটায়। বিরক্ত মুখে বলল, কী যে তোমার ঘুম, আধঘন্টা ধরে বেল টিপছি। তাড়াতাড়ি গোসলের পানি দাও। পুষ্প ঘুম-ঘুম চোখে রান্নাঘরে ছুটে গেল। প্ৰচণ্ড গরমেও রকিবের গোসলের পানিতে এক কেতলি ফুটন্ত পানি ঢালতে হয়। একটু ঠাণ্ডা পানি গায়ে লেগেছে কি লাগে নি, লোকটির ঠাণ্ডা লেগে যায়। খুখুক কাশি, গলা ব্যাথা। কী অদ্ভুত মানুষ।
রকিব বাথরুমে ঢুকে পড়ল। বাথরুমের দরজা বন্ধ করল না। রকিবের স্বভাব হচ্ছে গোলস করতে-করতে খানিকক্ষণ কথা বলা। বাথরুমের দরজা খোলা এই কারণেই। পুষ্পের এটা ভালো লাগে না। বলেছেও কয়েক বার।
রকিব কান দেয় নি।
পুষ্প, বাড়ি একটা পাওয়া গেছে।
তাই নাকি?
দুটো রুম। নেট দেওয়া বারান্দা। গ্যাস ইলেকট্রিসিটি দুই-ই আছে।
ভাড়া কত?
কম। খুবই কম।
কত?
আন্দাজ কর তো দেখি?
পনের শ?
রকিব মনের আনন্দে খানিকক্ষণ হাসল। যেন সে মজা পাচ্ছে।
বল না কত?
বার। ওনলি টুয়েলভ হাড্রেড।
সত্যি?
হুঁ। একটা সমস্যা আছে। সাময়িক সমস্যা। ফর দা টাইম বীইং একটু অসুবিধা হবে। ধর তিন-চার মা। তার পরই সমস্যার সমাধান।
সমস্যাটা কী?
পানির কানেকশন দেয় নি। মাস তিনেক লাগবে। ওয়াসার ব্যাপার।
পুষ্প অবাক হয়ে বলল, পানি ছাড়া চলবে কীভাবে?
সব ঠিক করে রেখেছি। একটা ড্রাম কিনে ফেলব। লোক রাখব। ঠিকা লোক। তার কাজই হবে সকালবেলা ড্রাম ভৰ্তি করে দেওয়া। এক ড্রামের বেশি পানি তো আমাদের লাগবে না।
পুষ্প ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। এক বার ভাবল বলবেপানি-ছাড়া বাড়িতে যাব না। বলল না, কারণ বললেই চেঁচামেচি শুরু করবে। রাতে হয়তো ভাতও খাবে না। ধীরেসুস্থে বললেই হবে। পুষ্প খাবার বাড়তে শুরু করল। খাবারের আয়োজন খুবই খারাপ। ডাল চচ্চড়ি আর ভর্তা।
পুষ্প বলল, আস্তে আস্তে খাও। আমি চট করে একটা ডিম ভেজে আনি।
ডিম লাগবে না। এতেই হবে।
না, হবে না।
তা হলে ঐ সঙ্গে দুটো শুকনো মরিচ ভেজে আনবে।
রকিবের চোখ উজ্জ্বল। বাড়ির সমস্যা মিটে গেছে, এই আনন্দ ফুটে বেরুচ্ছে। সে ভাত মাখতে-মাখতে বলল; পানির এত দরকারও আমাদের নেই। মরুভূমিতে লোকজন কী করে? এক গ্রাস পানি হলে তাদের তিন দিন চলে যায়।
আমরা তো আর মরুভূমিতে থাকি না।
তা না থাকলাম। তাই বলে অপচয় করব?
পুষ্প এক সময় বলল, তোমার বন্ধু মিজান সাহেবকে বল না, উনি যে এক বার বলেছিলেন বাড়ি দেখে দেবেন।
ওর কথা বাদ দাও। এক শ ধান্ধায় থাকে। ঝোঁকের মাথায় বলেছিল, এখন হয়তো মনেও নেই।
তবু এক বার বলে দেখা
আচ্ছা বলব। বাসায় চা খেতে এক দিন ডাকব। তখন মনে করিয়ে দিলেই হবে। লাভ হবে না। ঢাকা শহরে দুই হাজারের নিচে বাড়ি নেই। এটা হয়ে গেছে বড়লোকের শহর।
শোবার সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়া রকিবের স্বভাব। মশারির ভেতর থেকে আধখানা শরীর বের করে আয়েশ করে সিগারেট খায়। সিগারেটের শেষ অংশ হাতে থাকতে থাকতেই তার ঘুম এসে যায়। আজ রুটিনের সামান্য ব্যতিক্রম হচ্ছে। রকিব খাতাকলম নিয়ে বসেছে। পুষ্প বলল, চিঠি লিখছ?
উঁহু, একটা হিসাব। জটিল হিসাব।
কিসের হিসাব?
বার শ টাকা যদি বাড়িভাড়া হয়, তা হলে সেভিংস কিছু থাকে কি না। আমার খরচটা ধরি–বাসভাড়া, হাত-খরচ, পান-সিগ্রেট–ধর দুই শ।
দু শ-তে হবে না, তিন শ।
আচ্ছা, ধর তিন শ। চাল আমাদের কতটুকু লাগে? আধ মণ লাগে? আধ মণ তো লাগার কথা না। ধর আধ মণই। আধ মণের দাম কত? সরেসটা ধরবে, না প্লেইন? ইরি কত করে মণ।
সাড়ে চার শ টাকা মণ। আধ মণ হচ্ছে দুই শ পঁচিশ।
ধরলাম দুই শ পঁচিশ।
পুষ্প বলল, এস শুয়ে পড়ি। সকালে হিসাবনিকাশ করবে। ঘুম পাচ্ছে। বাবু দুপুরে ঘুমুতে দেয় নি।
কতক্ষণ আর লাগবে। খুব টাইট বাজেটের ভেতর দিয়ে চললে আমার মনে হয় কিছু সেভ করা যাবে।
পুষ্প মশারির ভেতর ঢুকে গেল। আশ্চর্যের ব্যাপার, শোয়ামাত্র তার ঘুম কেটে গেল। মনে হতে লাগল তার মতো সুখী মেয়ে এই পৃথিবীতে নেই। ছোট্ট সংসার। ভালোমানুষ ধরনের স্বামী। শাশুড়ি-ননদের কোনো ঝামেলা নেই। এর চেয়ে বেশি সুখী একটি মেয়ে কী করে হয় তার জানা নেই।