পুষ্প হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মিশ্রবাবু বিজয়ীর দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাচ্ছেন। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তাঁর এই দীর্ঘ জেরার মূল উদ্দেশ্যই ছিল মেয়েটিকে কাঁদিয়ে দেওয়া। নিশাত বিড়বিড় করে বলল, লোকটা এসব কী বলছে? এত নোংরা কথা সে কী করে বলছে? জহির তার দিকে তাকিয়ে বলল, আরো হয়তো কত কী বলবে! মনে হচ্ছে এটা মাত্ৰ শুরু। তবলার ঠুকঠাক।
পুষ্পর কান্না তখন পুরোপুরি থামে নি। সে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে উঠছে। এর মধ্যেই আবেগশূন্য গলায় মিশ্রবাবু তাঁর ডিফেন্স পেশ করলেন, এই মামলায় দীর্ঘ ক্রস একজামিনেশন বা প্রচুর সাক্ষ্য-প্রমাণের কোনো প্রয়োজন দেখছি না। ডাক্তারের দেওয়া মেডিকেল রিপোর্টই যথেষ্ট মনে করি। সেখানে বলা হয়েছে কোনন সিমেন পাওয়া যায় নি। ধর্ষণের সময় ভিকটিম সাধারণত প্রবল বাধা দেয়, সে-কারণে তার শরীরে নানান ক্ষত থাকে, তাও নেই। মামলা ডিসমিসের জন্যে এই যথেষ্ট। তবুও ঘটনাটা কী আমি বলছি। বিশ্বাস না-করলেও মামলার ক্ষতি হবে না। তবে ঘটনাটি বিশ্বাসযোগ্য, তা আপনারা সবাই স্বীকার করবেন।
এই সমাজে কিছু-কিছু লোক তাদের সুন্দরী স্ত্রীদের ব্যবহার করে কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধার জন্যে। রকিব সেই রকম একজন মানুষ। সে ক্রমাগত তার ধনী বন্ধুর কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে এবং ইন রিটার্ন এগিয়ে দিচ্ছে সুন্দরী স্ত্রীকে। স্ত্রীও স্বামীর কথামতোই কাজ করছেন। মিলনের ক্ষেত্র তৈরি করবার জন্যে পুত্ৰকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি মহিলার প্রতি কৃতজ্ঞ যে পুত্রের সামনে বৃন্দাবন লীলা না দেখানোর মতো সুবুদ্ধি তাঁর হয়েছে।
কোর্ট সেদিনকার মতো অ্যাডজর্নড হয়ে গেল। নিশাত চোখে অন্ধকার দেখল। এ তো ভরাড়ুবি! সরদার এ করিম কোর্ট অ্যাডজর্নড হবার সঙ্গে-সঙ্গেই চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কী হবে এ নিয়ে সে কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারল না। পুষ্প ক্রমাগত কাঁদছে। তাকে সামলাননও এক মুশকিল। লোকজনের কৌতূহলেরও কোন সীমা নেই। এক ফটোগ্রাফার বিশেষ অ্যাংগেল থেকে পুষ্পর কান্নার ছবি তোলবার চেষ্টা করছে। ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসাও মুশকিল। নিশাতের নিজেরও কান্না পেয়ে গেল।
আসামীর ক্রস একজামামিনেশন
আজ আসামীর ক্রস একজামামিনেশন হবে।
আসামী কাঠগড়ায় উপস্থিত।
সরদার এ. করিম এগিয়ে গেলেন।
আপনার নাম মিজানুর রহমান?
জ্বি।
পুষ্প নামের মেয়েটিকে আপনি চেনেন?
জ্বি চিনি।
সে যে অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে করেছে সেই সম্পর্কে আপনি কী বলতে চান?
অভিযোগ সত্যি নয়।
আমার জেরা শেষ হয়েছে। আপনি নেমে যেতে পারেন। এখন আমি আমার বক্তব্য পেশ করব।
মিজান অবাক হয়ে তাকাল। জজসাহেব তাকালেন। কোর্টে মৃদু একটা গুঞ্জন হল। করিম সাহেব সুবার বিস্ময় উপভোগ করলেন। নিশাতের দিকে তাকিয়ে হাসির মতো ভঙ্গি করলেন। ইচ্ছে করেই এই নাটকীয়তা তিনি করছেন। এতে সবার মনোযোগ খুবই তীব্রভাবে তিনি আকর্ষণ করতে পারলেন। এর প্রয়োজন ছিল।
মাননীয় আদালত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আমি এখানে একটি দুর্বল মামলা পরিচালনা করতে এসেছি। আমার মক্কেলের মেডিকেল রিপোর্টে কিছু পাওয়া যায় নি। কোন প্রত্যক্ষদশীর সাক্ষ্য আমরা জোগাড় করতে পারি নি।
আপনাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, এ-দেশের ধর্ষিতা মেয়েদের মেডিকেল রিপোর্টে কখনো কিছু পাওয়া যায় না। ধর্ষিতা মেয়েরা প্রথমে যে কাজটি করেন তা হচ্ছে ধর্ষণের সমস্ত চিহ্ন শরীর থেকে মুছে ফেলেন। অনেক বার করে স্নান করেন। গায়ে সাবান ঘষেন। কারণ তাঁদের ধারণা নেই যে, এটা করা যাবে না। এটা করলে আসামীকে আমরা আইনের জালে আটকাতে পারব না।
আসামীকে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে আরেকটি বড় বাধা সামাজিক বাধা। এই লজ্জা এবং অপমানের বোঝ কোনো মেয়ে সাহস করে নিতে চায় না। যখন কেউ সাহস করে, তখন কোর্ট তাকে মোটামুটিভাবে ব্যাভিচারিণী হিসেবে প্রমাণ করে দেয়। আমার মক্কেলের ব্যাপারেও সেটা ঘটেছে। তবে আমার মক্কেল শেষ পর্যন্ত কোনে মামলা নিয়ে আসতে পেরেছে, এটা তার জন্যে একটা বড় বিজয়। অনেকেই তা পারে না। তাদের মামলা তুলে নিতে হয়। যেমন মামলা তুলে নিতে হয়েছিল ২১-বাই-বি ঝিকাতলার আশরাফী খানমকে।
আশরাফী খানম আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ৫ই এপ্রিল ১৯৭৬ তারিখে মোহাম্মদপুর থানায় ডাইরি করিয়েছিলেন। সেই ডাইরিতে উল্লেখ আছে যে জনৈক মিজানুর রহমান তাঁকে ধর্ষণ করে। যথারীতি পুলিশ তদন্ত হয়। তবে তদন্তের মাঝামাঝি ফরিয়াদী পক্ষ কেইস উঠিয়ে নেয়। হয়তোবা আমি বলতে পারি কেইস উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়। যদি সেদিন সে তা উঠিয়ে না নিত তা হলে আজ এই মেয়েটি ধর্ষিতা হত না।
মাননীয় আদালতের কাছে আমি জানতে চাচ্ছি আমরা কি তৃতীয় একটি মেয়েকে ধর্ষিতা হবার ক্ষেত্র প্রস্তুত রাখব নাকি রাখব না।
আমার বক্তব্য এই পর্যন্তই। আশরাফী খানম মোহাম্মদপুর থানায় যে-জবানবন্দি দিয়েছিলেন তার কপি আমি আদালতে পেশ করেছি।
করিম সাহেব বসে পড়লেন। দীর্ঘ সময় আদালতে কোন সাড়াশব্দ হল না। এ. করিম সাহেব নিশাতের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, আমার তো ধারণা আমরা কেইস জিতে গেছি। আপনার কি তাই মনে হচ্ছে না?
নিশাত খুব কাঁদছে
নিশাত খুব কাঁদছে। জহির অবাক হয়ে বলল, তুমি এত কাঁদছ কেন? মামলা তো জিতে গেলে একটা লোককে সারা জীবনের জন্যে জেলে পাঠিয়ে দিলে। আজ তো তোমার আনন্দ করার দিন। ব্যাপারটা কি বল তো?