ইতি
মোহাম্মদ ইসমাইল।
কাজের চিঠি। তুমি কেমন আছ জাতীয় একটা বাক্য পর্যন্ত নেই। যেন চিঠিটা কোনো মানুষের লেখা নয়, যন্ত্রের লেখা। নিশাত তাকাল জহিরের দিকে। রাগের কঠিন ভঙ্গিগুলি এখন আর জহিরের চেহারায় নেই। সে নিজেকে সামলে ফেলেছে। এখন সে বেশ সহজ ভঙ্গিতে কথা বলবে, যেন দু জনের মধ্যে কখনো কিছু হয় নি।
জহির খবরের কাগজ ভাঁজ করে রেখে হাসিমুখে বলল, চিঠি পড়লে?
হ্যাঁ।
পরে এই চিঠির ব্যাপার নিয়ে আলাপ করব। এখন বল তোমার প্রোগ্রাম কি?
আমার প্রোগ্রাম দিয়ে কী করবে?
তোমার দুলাভাই সবাইকে নিয়ে বড় কোন জায়গায় খেতে চান। নির্ভর করছে। তোমার প্রোগ্রামের উপর। যা ব্যস্ত তুমি। আজ সন্ধ্যায় সময় হবে?
হবে।
ভালো। তোমার দুলাভাই মানুষটি খুব চমৎকার। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
আর আমার বোন?
তিনি তোমার মতোই।
আমার মতো বলতে কী মিন করছ? আমি মন্দ না ভালো।
কখনো-কখনো ভালো। কখনো মন্দ।
উদাহরণ দাও। আমি কখন ভালো কখন মন্দ।
কারো সাতে-পাঁচে থাক না। নিজের মতো জীবন যাপন কর। এটা খুব ভালো। আবার কোনো-কোনো ক্ষেত্রে বাইরের জিনিস নিয়ে মাতামাতি কর, এটা মন্দ।
পুষ্পের ব্যাপারটার কথা বলছ?
হ্যাঁ।
এই ঝামেলা এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে, স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের কেইস। খুব দ্রুত হয়। পুলিশ আজকালের মধ্যে চার্জশিট দিয়ে দেবে। বাকি রইল শুধু এক জন। ভালো উকিল।
পাও নি এখনো?
পেয়েছি, আজ কথা হবে।
জহির মুখ নিচু করে হাসছে। নিশাত বলল, হাসছ কেন? হাসির কী বললাম?
তোমার দুলাভাই বলছিলেন, তোমার কিছু করবার নেই, তাই বাইরের যন্ত্রণা নিয়ে মাতামাতি করছ। তোমার দু-একটা ছেলেপুলে থাকলে এটা করতে না। আমাকে
এই লাইনে কিছু সৎ পরামর্শ দিলেন।
পরামর্শ তোমার মনে ধরেছে?
হ্যাঁ। চল একটা বাচ্চাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসি।
নিশাত বাইরের দিকে তাকাল। কী চমৎকার একটা কথা বলেছে—একটা বাচ্চাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসি। একমাত্র বাবা এবং মা এই দুজনে মিলেই অদৃশ্য, অচেনা, রহস্যময় জগৎ থেকে একটা শিশুকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন।
কী ব্যাপার নিশাত, এরকম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছ কেন? তোমার মত নেই?
নিশাত কোমল স্বরে বলল, আমার মত আছে।
বলেই তার কেমন যেন লজ্জা লাগল। চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। লজ্জা ঢাকার জন্যে উঠে বারান্দায় চলে গেল। খুব ইচ্ছা করছে পুষ্পের বাচ্চাকে ধরে এনে কিছুক্ষণ আদর করতে। সময় নেই। উকিলের খোঁজে যেতে হবে। সরদার এ. করিম। ক্রিমিন্যাল আইনের ওস্তাদ লোক। তার হাতে এক বার ব্যাপারটা তুলে দিতে পারলে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়।
নিশাত!
কি?
তোমার গোলাপের উবগুলির অবস্থা দেখছ? সবগুলি গাছে পোকা ধরেছে। গত সপ্তাহে তুমি ইনসেকটিসাইড দাও নি, তাই না?
ভুলে গিয়েছিলাম।
তাই দেখছি। জগৎ-সংসার ভুলে যেতে বসেছ। কয়েক দিন পর দেখা যাবে আমার কথাও তোমার মনে নেই।
নিশাত কিছু বলল না। গোলাপগাছগুলির অবস্থা সত্যিই কাহিল। পানিও দেওয়া হয় না। টব শুকিয়ে খটখট করছে। সত্যি খুব অন্যায় হয়েছে। তৃষ্ণায় এদের বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল, অথচ পানির কথা কাউকে বলতে পারে না। নিশাত গাছগুলিতে পানি দিল। ওষুধ স্প্রে করে দিল। এই ওষুধটা দেওয়ার সময় কেন জানি তার গা কাঁপে। কঠিন বিষ। অথচ কী সুন্দর সোনালি রঙ। ইচ্ছা করে পরিষ্কার ঝকঝকে একটা গ্লাসে ঢেলে এক চুমুকে শেষ করে দিতে।
নিশাত।
বল।
চল রওনা হওয়া যাক।
ডিনারের দাওয়াত, এত তাড়া কিসের।
একটু সকাল-সকালই যাওয়া যাক। গল্পগুজব করে ধীরেসুস্থে আবার রওনা হব।
সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় নিশাত শুনল পুষ্প কাঁদছে। বেশ শব্দ করেই কাঁদছে। নিশাতের ব্যাপারটা ভালো লাগল না। কান্না হচ্ছে একটি খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এমনভাবে কাঁদা উচিত নয় যে অন্য কেউ তা টের পেয়ে ফেলে। কে যেন বলেছিল কথাটি-তুমি যখন হাস তখন দেখবে অনেকেই তোমার সঙ্গে হাসছে, কিন্তু তুমি যখন কাঁদ তখন দেখবে কেউ তোমার সঙ্গে কাঁদছে না। এটা কার কথা? রামকৃষ্ণ পরমহংস, নাকি কবিরের দোঁহা?
বিখ্যাত লোকদেরই কি চেহারা খারাপ
সব বিখ্যাত লোকদেরই কি চেহারা খারাপ থাকে? সরদার এ. করিমকে দেখে নিশাতের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। একজন নিতান্তই বেঁটে মানুষ, কুঁজো হয়ে চেয়ারে বসে আছে। চোখ দুটি ব্যাঙের চোখের মতো অনেকখানি বের হয়ে এসেছে। চোখের মণি কটা। সবচেয়ে কুৎসিত দৃশ্য হচ্ছে নাকের ভেতরে বড়-বড় লোম বের হয়ে আছে।
উকিলদের গলার স্বর ভরাট হবার কথা। কথা বললেই কোর্ট-রুমের সবাই যেন শুনতে পারে। এঁর গলা মোটেই সেরকম নয়। মেয়েদের মতো চিকন গলা। তবে উচ্চারণ অত্যন্ত স্পষ্ট।
আপনি ফরহাদ সাহেবের মেয়ে?
জ্বি।
আপনার বাবা আমাকে টেলিফোন করেছিলেন।
আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। আপনি আমার বাবার বয়সী।
বাবার বয়সী সবলোকই কি আপনাকে তুমি করে বলে?
জ্বি-না।
তা হলে আমি বলব কেন? আচ্ছা শুনুন, কাজের কথায় আসি। আমি তো রেপ কেইস করি না। তবু কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখেছি নিতান্তই ভদ্রতার কারণে। শুধু শুধু সময় নষ্ট।
রেপ কেইস কেন করেন না জানতে পারি?
সত্যি-সত্যি জানতে চান?
চাই।
রেপ কেইসে জেতা যায় না। ভরাড়ুবি হয়। আর আপনার এই কেইসের কোনো আশা দেখছি না। মেডিকেল রিপোর্টে কিছু নেই। কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই। আসামী হচ্ছে মেয়ের স্বামীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।