পুষ্প শান্ত গলায় বলল, আমি কী চাই জান? আমি চাই সবাই শয়তানটাকে দেখুক। সবার সামনে শয়তানটার কঠিন শাস্তি হোক, তারপর আমরা কোনট-এ। অচেনা জায়গায় চলে যাব। সেখানে কেউ আমাদের চিনবে না। কেউ কিছু জানবে না। আমরা নিজেরা-নিজেরা থাকব।
অচেনা জায়গায় চাকরিটা আমাকে দেবে কে?
নিশাত আপা জোগাড় করে দেবেন। আমাকে বলেছেন। উনি সব ভেবে রেখেছেন। তিনি কী বলেছেন বলব?
রকিব জবাব দিল না। পুষ্প আগ্রহ নিয়ে বলতে লাগল, নিশাত আপা বলেছেন তোমার জন্যে সিলেট চা-বাগানে একটা চাকরির ব্যবস্থা করবেন। নিশাত আপার শ্বশুর একটা চা-বাগানের মালিক। এখানে তুমি যা বেতন পাও, সেখানেও তাই পাবে। কি, কথা বলছ না কেন?
তোমার নিশাত আপার এত দরদ কেন?
মানুষের জন্যে মানুষের দরদ থাকবে না? পৃথিবীর সব মানুষই কি তোমার বন্ধুর মতো?
ঐসব হচ্ছে মুখের কথা। চা-বাগানে চাকরি জোগাড় করবে? চাকরি এত। সোজা?
নিশাত আপা করবে।
আর করলেইবা সেই চাকরি আমি নেব কেন? দয়া-দেখানো চাকরি। ঐসবের কোনো ভবিষ্যৎ আছে?
ভবিষ্যৎ নাই-বা থাকল। নিরিবিলি একটা জায়গায় না হয় নতুন করে জীবন শুরু করলাম।
পুষ্প গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে, রকিব কিছু বলছে না।
বৃষ্টির জোর কমে আসছে। জানালা গলে হিম-শীতল বাতাস ঢুকছে। মশারি নৌকার পালের মত ফুলে-ফুলে উঠছে।
পল্টু জেগে উঠেছে। অন্ধকার দেখে কাঁদছে। পুষ্প কিছু বলছে না। যেন তার ছেলের কান্না শুনতে পাচ্ছে না।
কোনো কারণে জহির রেগে আছে
নিশাতের মনে হল আজ কোনো কারণে জহির রেগে আছে। জহির খুব সহজে রাগ আড়াল করে রাখতে পারে। প্রচণ্ড রাগ নিয়েও সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলতে পারে, হাসতে পারে। বিয়ের প্রথম-প্রথম ব্যাপারটা সে বুঝতে পারে নি। এখন পারে। চেহারা দেখে বলে দিতে পারে জহির রেগে আছে কি রেগে নেই।
এখন যেমন পারছে। তবে রাগের কোনো কারণ নিশাত ধরতে পারছে না। গত কাল অনেক রাত পর্যন্ত তারা ও-বাড়িতে ছিল। জহির খুব আগ্রহ নিয়ে দুলাভাইয়ের সঙ্গে গল্প করেছে। দুলাভাইয়ের অতি তুচ্ছ রসিকতাতেও খুব শব্দ করে হেসেছে। জহিরের জন্যে ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক। তবে বোঝা গেছে সে খুব আনন্দে আছে। আজ এই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কী হল? অফিসে কোন গণ্ডগোল হয়েছে? অফিসের গণ্ডগোলে বিচলিত হবার লোক তো জহির নয়।
নিশাত নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। স্বামীকে লক্ষ করতে লাগল দূর থেকে। জহির অফিসের কাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় চা খেতে এল। এটা তার রুটিন। পরপর দু কাপ চা নিঃশব্দে খাবে। কোনো রকম কথা বলবে না। চোখের সামনে থাকবে খবরের কাগজ কিংবা কোনো গল্পের বই। আজ রুটিনের ব্যতিক্রম হল। জহির চায়ের কাপে চুমুক দিতে-দিতে বলল, বাবার চিঠি পেলাম। আগামাথা কিছু বুঝতে পারছি না। নিশাত, তুমি একটু পড়ে দেখবে?
নিশাত বলল, যে-চিঠির আগামাথা তুমি বোঝ নি, আমি কী করে বুঝব? আমার কি এত বুদ্ধি?
বাবা লিখেছেন, তুমি নাকি তাঁর কাছে একটা চাকরি চেয়েছ। চা-বাগানের চাকরি।
আমার নিজের জন্যে না, অন্যের জন্যে।
কার জন্যে জানতে পারি?
পার। পুষ্পের স্বামীর জন্যে। ঘটনা প্রকাশ হয়ে গেলে ও বেচারা থাকতে পারবে। না। নিরিবিলি কোন জায়গায় তাদের চলে যেতে হবে।
জহির কথা বলছে না। চায়ের কাপেও চমক দিচ্ছে না। সে রাগ সামলাবার চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারবে কি না কে জানে। নিশাত বলল, তোমার চা কিন্তু ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
জহির চায়ের কাপে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে কাপ সরিয়ে রাখল। নিচু গলায় বলল, তোমার কি মনে হয় না, তুমি সমস্ত ব্যাপারটা নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করছ?
না, তা মনে হয় না।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে।
মনে হলে কিছু করার নেই।
ব্যাপারটা তুমি কি ভুলে যেতে পার না? অনেক কিছু তো করলে, আর কেন?
আমি কিছুই করি নি। চিঠিটা পড়ে দেখি।
আমার কোটের পকেটে আছে।
নিশাত উঠে চিঠির খোঁজে ভেতরে গেল। চিঠি নিয়ে এসে আবার বসল জহিরের – সামনে। মানুষটা কী কঠিন দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে খাম খুলল।
নিশাত ভেবে পাচ্ছে না তার চিঠির উত্তরে উনি জহিরকে কেন লিখবেন। চাকরি কি দিতে পারবেন না? এই কথা সরাসরি জানাতে সঙ্কোচ করছেন?
শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে নিশাতের সম্পর্ক খুব ভালো নয়। ওদের সবই যেন কেমন আলগা-আলগা। নিশাতের শ্বশুর ইসমাইল সাহেব দশ মিনিট কখনন কারো সঙ্গে কথা বলেন না। নিশাতের সঙ্গে কথাবার্তা হ্যা-র মধ্যে রেখেছেন। তবে জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, নববর্ষ—এইসব উপলক্ষে লোক মারফত একটা বড় প্যাকেট এসে। উপস্থিত হয়। সঙ্গে ইংরেজিতে একটা নোটার সারমর্ম, এই আনন্দ তোমার জীবনে অক্ষয় হোক।
জহিরের কাছের চিঠিটিও ইংরেজিতে লেখা। টাইপ করে পাঠিয়েছেন। এই চিঠিরও নিশ্চয়ই কয়েকটি কপি আছে, ফাইল কপি, অফিস কপি। নিশাত চিঠি পড়ল–
প্রিয় জহির,
নিশাত সম্প্রতি আমার কাছে চা-বাগানের একটি চাকরি চেয়ে চিঠি দিয়েছে। চাকরি কার জন্যে এবং সেই চাকরিপ্রার্থীর অভিজ্ঞতা কী তা লেখে নি। আমি নিজে যাচাই না করে কাউকে চাকরি দিই না। তবে নিশাতের জন্যে একটি ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তোমার স্ত্রীকে আমি খুব পছন্দ করি। তার অনুরোধ নিশ্চয়ই রাখব। তোমাকে এই চিঠি লেখার কারণ হচ্ছে তুমি আমাকে চাকরিপ্রাথী সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য দেবে। সে যেন চা-বাগানে চাকরি চেয়ে একটি দরখাস্ত করে। দরখাস্ত অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হতে হবে। তোমার কাছ থেকে চিঠি। পাবার পর আমি নিশাতকে চিঠি দেব।