সে না হয়ে অন্য কেউ হলে একটা রিকশা পেয়ে যেত। সে বলেই পেল না। হেঁটে হেঁটে কাদায়-পানিতে মাখামাখি হয়ে এতটা পথ আসতে হল।
বাসা ঘন অন্ধকারে ড়ুবে আছে। পুরো অঞ্চলে ইলেকট্রিসিটি নেই। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে পুষ্প বসে আছে। ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আছে। কেন জানি মনে হচ্ছিল মিজান ছাড়া পেয়েছে। ছাড়া পেয়েই চলে এসেছে এখানে। দরজায় ধাক্কা দিয়ে হাসি-হাসি গলায় বলবে, ভাবি চিনতে পারছেন তো, অধমের নাম মিজান। রকিব যখন দরজায় ধাক্কা দিল, উঁচু গলায় বলল, দরজা খোল—তখনন তার পুরোপুরি বিশ্বাস হয় নি এটা রকিব। পুষ্প ভয়ে কাতর গলায় বলেছে, কে, কে? পল্টু ঘুমিয়ে পড়েছিল। পল্টুকে ধাক্কা দিয়ে জাগাল। যেন এই শিশুটিও মায়ের বিপদে পাশে এসে দাঁড়াবে।
দরজা খোল না। এই পুষ্প।
পুষ্প দরজা খুলল। কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, কোথায় ছিলে তুমি? ইস, কি অবস্থা হয়েছে। এরকম করে ভিজলে কেন?
রকিব জবাব দিল না। বাথরুমে ঢুকে গেল। পুষ্প বলল, ভয়ে আমি মরে যাচ্ছিলাম। নিশাত আপারাও নেই সন্ধ্যা থেকে। বাসায় ইলেকট্রিসিটি নেই। তুমি কথা বলছ না কেন? ভাত গরম করব?
রকিব সেই প্রশ্নের উত্তর দিল না।
এ্যাই, কথা বলছ না কেন?
ভালো লাগছে না তাই বলছি না। এসেই প্ৰেমালাপ শুরু করব নাকি? অবস্থাটা দেখছ না!
ভাত বাড়ব?
না, পানি গরম কর। গোসল করব।
পুষ্প গরম পানি এনে দিল একটামাত্র মোমবাতি, তাও শেষের দিকে চলে এসেছে। শেষ হলেই অন্ধকারে ঘর ঢেকে যাবে। প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। শক্ত বাতাসও দিচ্ছে। আজ সারা রাত নিশ্চয়ই কারেন্ট আসবে না।
আজ সকালবেলা নিশাত আপা এসেছিলেন। ওনার বোন আর দুলাভাই এসেছেন এই জন্যে তাঁরা কদিন ঐ বাড়িতে থাকবেন। কীরকম ভয়ের ব্যাপার না?
ভয়ের কী আছে এর মধ্যে?
এত বড় বাড়িতে আমরা একা। বাড়িওয়ালা তো নেই, শুধু তার ভাগ্নেটা আছে। ওকে দিয়েই মোমবাতি আনালাম।
ভালো করেছ।
গোসল শেষ হতে হতে মোমবাতি ফুরিয়ে গেল। রকিব বিরক্ত মুখে বলল, আর নেই মোমবাতি?
না।
একেকটা কাজ যা কর না! দুটো মোম আনতে কি অসুবিধা ছিল?
পুষ্প ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। এখন চুপ করে থাকাই ভালো। রকিব কোনো কারণে রেগে আছে। অফিসে কিছু হয়েছে বোধহয়। অফিসে কিছু হলেই সে কয়েক দিন রেগে থাকে। কথা বললেই রেগে যায়।
পুষ্প ভাত খেল না। অন্ধকারে খাবে কীভাবে? সে অনেক দিন পর রকিবের পাশে নিজের বালিশ রাখল। এই কদিন তাদের দুজনের মাঝখানে বাবু ঘুমিয়েছে।
নিশাত আপা বাবুর জন্যে খুব দামি একটা প্যান্ট আর শার্ট এনেছেন। দেখবে?
অন্ধকারে দেখব কীভাবে? আমি বিড়াল নাকি?
পুষ্প লক্ষ করল রকিবের গলা তরল হয়ে আসছে। সেই রাগীরাগী ভাবটা এখন নেই।
তোমার গলার ব্যথাটা কমেছে?
না, এই ঘোড়ার ডিম আর কমবে না।
মাথা টিপে দেব?
ব্যথা করছে গলা, মাথা টিপে দিলে কী হবে?
পুষ্প হেসে ফেলল। এই তো মানুষটা সহজ হয়ে গেছে।
চা করে দেব? চা খাবে টোস্ট বিসকিট দিয়ে। রাতে কিছু খেলে না তো! খিদে লাগছে না?
লাগছে।
দেব করে?
দাও, বরং চারটা ভাতই দাও। অন্ধকারে খাব কী করে?
পুষ্প উঠে বসল। একটা হাত রাখল রকিবের গায়ে। তার মনে কিছু কথা জমে আছে, বলবে-বলবে করেও বলা হয় নি। এই অন্ধকারে বলে ফেললে কেমন হয়। আঁধার সেই কথাগুলি বলবার জন্যে বিশেষ একটা পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে।
এই শোন, একটা কথা বলি?
বল।
ঐ ঘটনার পর থেকে তুমি এক দিনও আমাকে আদর কর নি। আচ্ছা, আমাকে তোমার এখন ঘেন্না লাগে? না বল, আমি মন-খারাপ করব না। এখন কি আর আমার সঙ্গে ঘুমুতে ইচ্ছা করে না?
রোজই তো ঘুমাচ্ছি।
এই ঘুমের কথা বলছি না। আমাকে তোমার এখন ঘেন্না লাগে?
আরে কী যে বল। মনমেজাজ ঠিক নেই। মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। এখন কি এসব ভাল লাগে? ইচ্ছা করে ঘরবাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে চলে যেতে।
পুষ্প অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। বৃষ্টির বেগ আগের মতোই আছে। ঢাকা শহর মনে হচ্ছে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। পুষ্প অস্পষ্টভাবে প্রায় ফিসফিস করে বলল, আজ আমাকে একটু আদর করবে?
অসুখবিসুখের মধ্যে এইসব যন্ত্ৰণা ভালো লাগে? বলেই রকিব স্ত্রীকে টেনে নিল। গভীর আনন্দে পুষ্পের চোখে পানি এসে গেছে। তার মনে হচ্ছে পাশের মানুষটি ছাড়া পুষ্প আর কাউকে চেনে না। আর কেউ তার নেই। এই মানুষটি একটি কড়া কথা বললে সে ছাদ থেকে লাফিয়ে রাস্তায় পড়ে যাবে। এই মানুষটি……
পুষ্প আর ভাবতে পারছে না। জগৎ-সংসার দুলে উঠতে শুরু করেছে। কী অপূর্ব, কী রহস্যময় স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসাবাসির এই গোপন সম্পর্ক।
পুষ্প।
উঁ।
আমরা সুখেই আছি, তাই না?
আমার একটা কথা শুনবে পুষ্প?
কী কথা?
বলছি। কিন্তু বল, তুমি শুনবে?
হ্যাঁ।
রকিব পুষ্পকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে এল। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, তোমার ব্যাপারটা জানাজানি হোক এটা আমি চাই না পুষ্প। জানাজানি হলে কী হবে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখ।
কী হবে?
খবরের কাগজে উঠবে। সবাই কেমন করে আমাদের দিকে তাকাবে। পল্টু বড় হয়ে জানবে। আত্মীয়স্বজনরা কানাকানি করবে।
লোকটার শাস্তি হোক তুমি চাও না?
চাইব না কেন? অবশ্যই চাই। হারামজাদাকে আমি গুণ্ডা লাগিয়ে খুন করার।
পুষ্প হাসল। অন্ধকারে সেই হাসি রকিব দেখতে পেল না।
তোমাকে কথা দিচ্ছি পুষ্প। প্রফেশন্যাল লোক লাগিয়ে কুত্তার বাচ্চাটার ভুঁড়ি নামিয়ে ফেলব।