আসছি। নিশাত শোন, ঐ মেয়েটি, মানে পুষ্প, বেশ কয়েক বার এসে তোমার খোঁজ করে গেছে।
কিছু বলেছে?
না, বলে নি।
তুমি কি আসবার সময় জিজ্ঞেস করে আসবে কী ব্যাপার?
জহির কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে। না। তুমি ইনভলব্ড্ হয়েছ এই যথেষ্ট। পুরো পরিবারসুদ্ধ ইনভলব্ড্ হবার কোন কারণ দেখি না।
ইনভলব্ড্ হবার তো কথা হচ্ছে না। তুমি শুধু জিজ্ঞেস করবে কী ব্যাপার?
এর মধ্যে যদি এখানে আসে তা হলে জিজ্ঞেস করব। আমি নিজে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারব না।
আচ্ছা, তাই করো।
রকিব তিন দিন অফিসে এসেছে
রকিব তিন দিন পর আজ প্রথম তার অফিসে এসেছে। চুপচাপ তার চেয়ারে বসে আছে। টেবিলের ফাইলপত্র খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে রেখে দিল। তার মনে হচ্ছে সবাই তাকে অন্য রকম দৃষ্টিতে দেখছে। এখন পর্যন্ত কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে নি গত তিন দিন সে আসে নি কেন। অথচ এটা জিজ্ঞেস করা খুবই স্বাভাবিক।
পাশের টেবিলে বসে আজিজ খাঁ। তার বিশেষ বন্ধু। সেও এখন পর্যন্ত কিছু জিজ্ঞেস। করছে না। রকিব নিজ থেকেই বলল, জ্বরে পড়ে গিয়েছিলাম। গোসল করে ফ্যানের নিচে শুয়েছি, ফট করে ঠাণ্ডা লেগে গেল। সকালেও জ্বর ছিল।
আজিজ খাঁ তবু কিছু বলল না। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অথচ তার অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার কোন কারণ নেই। তার সমস্যার কথা এরা নিশ্চয়ই কিছু জানে না। কোনো পত্রিকায় কিছু ছাপা হয় নি। সব কটা পত্রিকা সে খুটিয়ে-খুটিয়ে পড়েছে। তা হলে সবাই এরকম করছে কেন? নাকি সবটাই তার মনের ভুল?
টিফিনের সময় এ. জি. এম. মনসুরউদ্দিন সাহেব তাকে ডেকে পাঠালেন। মনসুরউদ্দিন সাহেব ধমক না-দিয়ে অধস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেন না, এবং কাউকে বসতে বলেন না। কেউ যদি বসে পড়ে তিনি সরু চোখে তাকান। অথচ আজ তিনি রকিবকে ঘরে ঢোকামাত্র বসতে বললেন।
রকিব সাহেব চা খাবেন?
জ্বি-না স্যার।
কাল তিনটার দিকে আপনাকে এক বার খোঁজ করেছিলাম।
কাল আসি নি স্যার জ্বর ছিল। গোসল করে ফ্যানের নিচে শুয়েছিলাম, বুকে ঠাণ্ডা বসে গেছে।
ও আচ্ছা!
কী ব্যাপার স্যার?
না, মানে অফিসিয়াল কিছু না। এক ভদ্রলোক এসেছিলেন আপনার খোঁজে। আমার পরিচিত আর কি। ওনার কাছে শুনলাম।
রকিবের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।
রকিব সাহেব, আপনি কি কোনো পুলিশ কেইস করেছেন নাকি?
রকিব হ্যাঁ, না কিছু বলল না।
ভদ্রলোক ঐ ব্যাপারেই কথা বলতে এসছিলেন। মানে কোনো সেটেলমেন্টে আসা যায় কি না। অবশ্যি আপনিই ভালো বুঝবেন। আগে বলুন তো হয়েছেটা কি?
কিছু হয় নি স্যার।
ঐ ভদ্রলোকও তাই বলছিলেন। আমি ওনাকে আপনার বাসার ঠিকানা দিয়েছি। উনি ঠিক বাসায় যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী নন।
উনি কে স্যার?
মিজান সাহেবের মামা হন সম্পর্কে। চৌধুরী খালেকুজ্জামান। ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। আপনি বরং টেলিফোনে ওনার সাথে কথা বলুন। আমার কাছে একটা কার্ড আছে। এই নিন।
রকিব হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিল। মনসুরউদ্দিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, এই জন্যেই ডেকেছিলাম, অন্য কিছু না। আপনি খালেকুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলুন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। কোনো রকম সঙ্কোচ ছাড়া কথা বলবেন। খোলাখুলি কথা হওয়া ভালো। কি বলেন?
জি স্যার।
আমি বরং ওনার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিই। আজ সন্ধ্যাবেলা বাসায় চলে যান। ব্যস্ত মানুষ তো. অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া দেখা হওয়া মুশকিল। তা হলে কি
করব অ্যাপয়েন্টমেন্ট?
রকিব এমন ভাবে মাথা নাড়াল যার মানে হ্যা বা না দুই-ই হতে পারে। সে অফিসে চারটা পর্যন্ত বসে রইল। বিভিন্ন ফাইল খুলল এবং বন্ধ করল। চারটার পর সে বাসায় গেল না। পার্কের বেঞ্চিতে অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত বসে রইল। পার্কের কাছেই খালেকুজ্জামান সাহেবের বাসা। হেঁটে হেঁটেই যাওয়া যায়। রকিবের একবার মনে হচ্ছে তার যাওয়া উচিত, ভদ্রলোক কি বলেন শোনা উচিত। আবার পর মুহূর্তেই মনে হচ্ছে, কেন সে যাবে? তার কিসের গরজ?
রাত আটটা পর্যন্ত সে পার্কে বসে রইল। আটটার পর খালেকুজ্জামান সাহেবের বাসার সামনে উপস্থিত হল। বিশাল বাড়ি। গেট বন্ধ। খাকি পোশাক পরা দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। রকিব নিচু গলায় বলল, চৌধুরী সাহেব কি বাড়ি আছেন?
জ্বি আছেন। দেখা করবেন?
না, দেখা করব না। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
দারোয়ানের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে রকিব লম্বা-লম্বা পা ফেলে বাসার দিকে রওনা হল। রাস্তায় বাতি নেই। হাঁটতে কেমন গা ছমছম করে। লোকজনের চলাচলও খুব কম। ঢাকা শহর বদলে যাচ্ছে। রাত নটার পর রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়।
আকাশে মেঘ জমেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি নামলে খুব ঝামেলায় পড়তে হবে। ভিজতে-ভিজতে বাড়ি ফেরা। ঠাণ্ডা লেগে গেলে সর্বনাশ।
বড় রাস্তায় ওঠার আগেই বৃষ্টির ফোঁটা দু-একটা পড়তে শুরু করল। কিছু-কিছু রিকশা আছে, তারা কোথাও যাবে না। যাবে না তো রিকশা নিয়ে বসে আছে কেন কে জানে। রকিব চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ বসল। বৃষ্টি চেপে নেমেছে। ধরার কোনো লক্ষণ নেই। তাকে বাড়ি ফিরতে হবে কাকভেজা হয়ে। তার কপালটাই খারাপ। অফিস থেকে সরাসরি বাসায় চলে এলে এই ঝামেলা হত না।
বাসায় ফিরতে-ফিরতে রকিবের এগারটা বেজে গেল। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়েছে। গলা বসে গেছে। ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে প্ৰবল জ্বর আসছে। ঠাণ্ডা তার সহ্য হয় না। তার জীবনটা এমন কেন? যে-সব সহ্য হয় না বারবার সেসবের মধ্যে দিয়েই তাকে যেতে হয়।