নুরুদ্দিন বললেন, চলুন পৌঁছে দিয়ে আসি। আমার কিছু ইনফরমেশনও দরকার। ঐ সঙ্গে নিয়ে আসব।
গাড়িতে নিশাত আরেক বার বলল, রিপোর্ট কী পাওয়া গেছে? নুরুদ্দিন প্রশ্নের জবাব দিলেন না। অন্য একটা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর সম্ভবত এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করবার ইচ্ছা নেই। নিশাত আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
জহির এখন ফেরে নি।
নিশ্চয়ই বন্ধুবান্ধুব জুটিয়েছে। মাঝেমাঝে বন্ধুবান্ধব জুটে যায়। বাড়ি ফিরতে রাত হয়। তার চোখেমুখে অপ্ৰস্তুত ভাব লেগে থাকে। লজ্জিত-অনুতপ্ত মানুষের আচরণ দেখতে ভালো লাগে। নিশাতের মনে হল আজ তাই দেখবে।
সে রান্না চড়াল। সামান্য কিছু রান্না করবে—ভাত, দু পিস মাছ ভাজা, ডাল। ভাগ্যিস জহির তার বাবার মতো লোজনবিলাসী হয় নি। হলে মুশকিল হত। রান্নাঘরে সময় দিতে তার ভালো লাগে না।
রান্না শেষ করে নিশাত দ্বিতীয় বার স্নান করল। তবু নিজেকে ঠিক ফ্রেশ মনে হচ্ছে না। মনের কোথাও যেন খানিকটা কাদা লেগে আছে। এই কাদা কিছুতেই দূর হবে না। তার প্রচণ্ড খিদে লেগেছিল। এক বার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে খেতে বসে গেল। রাত দশটার মতো বাজে। আর অপেক্ষা করার অর্থ হয় না। জহির নিশ্চয়ই খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফিরবে।
পুষ্প কিছু খেয়েছে কি না কে জানে। হয়ত খায় নি। খোঁজ নেওয়া উচিত। কিন্তু প্রচণ্ড আলসেমিতে শরীর কেমন করছে। মনে হচ্ছে কোনোমতে বিছানায় গড়িয়ে পড়তে পারলে বেঁচে যাবে। তা ছাড়া এরা স্বামী-স্ত্রী এখন কিছু সময় একা থাকুক। এর প্রয়োজন আছে।
ভাত শেষ না-করেই নিশাত উঠে পড়ল। খিদে আছে, কিন্তু খেতে ইচ্ছা করছে না। অদ্ভুত শারীরিক অবস্থা!
জহির এল রাত এগারটায়। মুখে অনুতপ্ত মানুষের লাজুক হাসি। টাই খুলতে। খুলতে বলল, মহিউদ্দিনের পাল্লায় পড়েছিলাম। জোর করে ঢাকা ক্লাবে নিয়ে গেল। ইচ্ছা ছিল না। দু পেগ হুইস্কি খেতে হল। যত বলি লিকার আমার পছন্দ না, তত জোর করে। সব মাতালরা অন্যদের মাতাল বানানোর চেষ্টা করে। মনে করে এটা তাদের ডিউটি। ভাত খেয়েছ?
হ্যাঁ। তুমি নিশ্চয়ই খেয়ে এসেছ?
হুঁ। কেমন বমি-বমি লাগছে। হুইস্কি আমার একেবারেই সহ্য হয় না।
তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন কৈফিয়ত দিচ্ছ আমার কাছে। কৈফিয়ত দেবার কিছু নেই। খেতে ইচ্ছা করলে তুমি খাবে। মাতাল হতে চাইলে হবে। তোমার জীবন হচ্ছে তোমার, আমারটা আমার।
জহির বিস্মিত হয়ে বলল, তার মানে?
মানে কিছু নেই।
মনে হচ্ছে তুমি খুব রেগে গেছ।
না, আমি মোটও রাগি নি। এর আগেও তুমি অনেক বার লিকার খেয়ে বাড়ি ফিরেছ। কখনো আমি কিছু বলি নি। বলেছি?
তা বল নি, কিন্তু মুখ অন্ধকার করেছ। মুখ অন্ধকার করার চেয়ে বলে ফেলা ভালো।
আজও কি আমার মুখ অন্ধকার মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ।
দুঃখিত। মুখ অন্ধকার করতে চাই নি। হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়। তুমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছ না। বিশ্রাম নাও।
জিনিসটা আমার সহ্য হয় না, মাতালের পাল্লায় পড়ে……কড়া করে এক কাপ কফি করতে পারবে?
হ্যাঁ, পারব।
নিশাত রান্নাঘরে ঢুকল। কফি বানাল। টেবিলের উপর থেকে খাবারদাবার ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখল। জহির এসে উকি দিল রান্নাঘরে।
নিশাত, তোমার টেলিফোন। মোহাম্মদপুর থানা থেকে ইন্সপেক্টর নুরুদ্দিন তোমাকে চাচ্ছেন। ব্যাপারটা কি?
ব্যাপার কিছু না।
ব্যাপার কিছু না মানে? দুপুর-রাতে থানা থেকে তোমাকে টেলিফোন করবে। কেন? হয়েছেটা কি?
বললাম তো কিছু হয় নি।
নিশাত টেলিফোন ধরল। ইন্সপেক্টর নুরুদ্দিন বললেন, সরি, অনেক রাতে টেলিফোন করলাম।
অসুবিধা নেই। আমি জেগেই ছিলাম।
আমরা মিজানকে এই কিছুক্ষণ আগে গ্রেফতার করেছি, এই খবরটা আপনাকে দিলাম। আপনি যদি এঁকে খবরটা দেন, উনি হয়তো খুশি হবেন।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আরেকটা কথা আপনি বারবার জানতে চাচ্ছিলেন যে, মেডিকেল রিপোর্টে কিছু পাওয়া গেছে কি না। কিছু পাওয়া যায় নি।
সে-কী।
এইসব ব্যাপারে সাধারণত ধস্তাধস্তি হয়। জখম থাকে ভিক্টিমের গায়ে। কামড়ের দাগ থাকে। সে-সব কিছুই নেই।
ও অজ্ঞান ছিল?
হ্যাঁ, তাই। আমি বুঝতে পারছি। আমাদের এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে। কোর্টকে বোঝাতে হবে। মুশকিল কি হচ্ছে জানেন, কোনোসিমেনও পাওয়া যায় নি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তার কারণ বুঝতে পারছি। মেয়েটি নিশ্চয়ই বেশ কয়েক বার গোসল করেছে। এইসব ক্ষেত্রে মেয়েরা তাই করে। বিপদে পড়ি আমরা। চিহ্ন থাকে না।
কেইস দাঁড় করাতে পারবেন না?
আমার নাম নুরুদ্দিন-আমি খুব খারাপ লোক। আমি কেইস দাঁড় করিয়ে দেব। আপনারা খুব ভালো এক জন লইয়ার দেবেন। আচ্ছা রাখি।
নিশাত টেলিফোন রেখে দিল। জহির তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে থমথমে গলায় বলল, কি হয়েছে?
পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটি রেপ্ড্ হয়েছে।
তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি? তোমাকে টেলিফোন করেছে কেন?
আমি মেয়েটিকে পুলিশের কাছে নিয়ে গিয়েছি।
তুমি নিয়ে গেছ। কেন? তুমি কেন? তোমার কিসের মাথাব্যথা?
নিশাত চুপ করে আছে। জবাব দিচ্ছে না। এক বার ছোট্ট একটা হাই তুলল। জহির বলল, কথা বলছ না কেন?
তুমি সুস্থ না। কাজেই কথা বলছি না।
আমি সুস্থ না?
না। তুমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছ না। যা মনে আসছে বলছ। এখন আমি তোমার কোনো কথার জবাব দেব না।
নিশাত শোবার আয়োজন করছে। ঝাড়ন দিয়ে বিছানা ঝাড়ছে। মশারি জলে। কড়া বাতি নিভিয়ে নীল বাতি জ্বালাল, যেন কিছুই হয় নি। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার যেন কোন অস্তিত্ব নেই। নিশাত মশারির ভেতর থেকে বলল, এস, শুয়ে পড়। রাত কম হয় নি।