বলেন কী?
এই হচ্ছে দেশের অবস্থা।
তারপর আপনার বড় শ্যালক কী করলেন?
মামলা-মোকদ্দমা করছে, আর কী করবে? দু বছর হয়ে গেল—এক পয়সা ভাড়া দেয় নাই।
আমাকে দিয়ে ঐ ভয় নেই। এক তারিখে বেতন পাব, দুই তারিখে বাড়িভাড়া শোধ। সামনের মাসের এক তারিখে চলে আসব।
এই মাসটা আমি কী করব? আসতে হয় এই মাসে আসবেন। গোটা মাসের ভাড়া দেবেন। আর যদি তা না চান, মামলা ডিসমিস। বুঝলেন?
মামলা ডিসমিস করার দরকার নেই, আমি এই মাসেই আসব।
ভালো কথা, চাবি নিয়ে যান। আমি সপ্তাহে একদিন এসে বাড়ি দেখে যাব। বাড়ি হচ্ছে নিজের সন্তানের মতো। দেখাশোনা না করতে পারলে ভালো লাগে না। আপনার স্ত্রীকে বলে দেবেন।
কি বলে দেব?
এই যে সপ্তাহে-সপ্তাহে আসব, এইটা আর কি।
জ্বি, বলে দেব।
উঠবেন কবে?
দুই-এক দিনের মধ্যে।
পুষ্প চৈত্র মাসে বাড়িতে উঠতে রাজি হল না। চৈত্র মাসে নাকি নতুন কোন কাজ শুরু করতে নেই। সে মাস শেষ হলে নতুন বাড়িতে উঠবে। এর মধ্যে অল্প-অল্প করে গুছিয়ে রাখবে। নতুন বছরে সে গোছাননা বাড়িতে গিয়ে উঠবে।
বাড়ি গোছানোর পর্ব শুরু হল। বেতের চেয়ার কেনা হল। জানালার নীল পর্দা। একটা ছোট পড়ার টেবিল। বুক-কে। একটা চৌকি। ভেতরের বারান্দায় পাতা থাকবে। হঠাৎ আত্মীয়স্বজন এসে পড়লে থাকবে। পুষ্প তার নিজের টাকা ভেঙে রান্নাঘরের জন্যে একটা মিটসেফ কিনল। প্লাস্টিকের লাল রঙের বালতি।
নতুন সংসার শুরু করার প্রচণ্ড আনন্দ আছে। পুষ্প ছোটখাটো একটা-কিছু কেনে, আনন্দে চোখ ছলছল করতে থাকে। দোকানে গেলেই বেহিসাবী হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। কয়েক বার এরকম হয়েছে। এক শ পঁচিশ টাকা দিয়ে কিনেছে চিনামাটির লবণদান। জিনিসটা এত সুন্দর যে এতে লবণ রাখতে মায়া লাগে। সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছা করে। প্রায়ই সে ভাবে, তার যদি প্রচুর টাকা থাকত, কী সুন্দর করেই-না সে ঘর সাজাত! যে-ই দেখত সে-ই মুগ্ধ হয়ে যেত। এক দিন নিশ্চয়ই তার টাকা হবে। প্রচুর টাকা। তখন হয়তো ঘর সাজাতেই মন চাইবে না।
পুষ্প ছেলেকে কোলে নিয়ে নিশাতের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে কলিংবেল টিপল। সে আজ একটা বিশেষ কারণে এসেছে। পল্টুকে এখানে রেখে যাবে যাত্রাবাড়িতে। তার নানিজানকে নিয়ে এসে তার নতুন সংসারের শুরুটা দেখাবে।
কি ব্যাপার পূ? বেশ কদিন পর তোমাকে দেখলাম?
খুব ব্যস্ত আপা। আমাদের নতুন বাসাটা সাজাচ্ছি।
কী রকম সাজাচ্ছ, এক দিন গিয়ে দেখে আসতে হয়।
আপনি কি সত্যি যাবেন?
হ্যাঁ, যাব। তোমার জন্যে একটা ছবি আঁকছি, সেই ছবি তোমাদের বাসায় সুন্দর একটা জায়গায় টাঙিয়ে দিয়ে আসব।
কি ছবি আপি? একটু দেখি?
না, এখন দেখা যাবে না।
আপা, আপনি কি পল্টুকে একটু রাখবেন? ঘন্টা দুয়েকের জন্যে।
ঘন্টা দুয়েকের জন্যে তো রাখতে পারব না। কারণ এখন যাচ্ছি মার বাসায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব। সন্ধ্যা পর্যন্ত রাখতে চাইলে রেখে যাও।
তা হলে তো আপা আরো ভালো হয়।
খুব সাজগোজ করেছ দেখছি! যাচ্ছ কোথায়?
নানিজানের কাছে যাব। তারপর তাঁকে আমার নতুন বাসা দেখাতে নিয়ে আসব।
চমৎকার!
এই ব্যাগে ওর বাড়তি জামা আর প্যান্ট আছে।
টেবিলের উপর রেখে দাও।
আমি যাই আপা?
যাও।
যেতে গিয়েও পুষ্প হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। চাপা গলায় বলল, আপনি এত ভালো কেন আপা বলুন তো? জবাবের জন্যে অপেক্ষা করল না। ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল।
একটা ভুল হয়ে গেছে। রকিব যদি কোনো কারণে অফিস ফাঁকি দিয়ে চলে আসে, তা হলে ঘর বন্ধ দেখলে রেগে যাবে। একটা চিঠি লিখে দরজার সামনে টাঙিয়ে যেতে হবে। অবশ্যি চিঠি দেখলেও সে রাগ করবে। তবে নির্বোধ বলে গাল দিতে পারবে না। সে তো বুদ্ধি করে চিঠি লিখে যাচ্ছে।
পুষ্প লিখল, আমি নিজানকে দেখতে যাচ্ছি। চারটা বাজার আগেই চলে আসব। রাগ করবে না কিন্তু।
শেষ লাইনটা লেখা কি ঠিক হচ্ছে? অন্য কেউ যদি পড়ে? লাইনটা কাটতে ইচ্ছা। করছে না। আবার রাখতেও অস্বস্তি লাগছে।
ভাবি আসব? অধমের নাম মিজান—যদি ভুলে গিয়ে থাকেন। মিজানুর রহমান।
পুষ্প মুখ তুলে ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসল।
কোথাও বেরুচ্ছেন বুঝি? সাজসজ্জা দেখে তা-ই মনে হচ্ছে।
জ্বি।
সঙ্গে গাড়ি আছে, আসুন নামিয়ে দিই।
গাড়ি লাগবে না। আমি কাছেই যাব। ঐ তো পাশের বাসা।
আপনি কি আমাকে ভয় পান ভাবি?
জ্বি-না। ভয় পাব কেন? চা করে আনি? চা খাবেন?
আনুন। আপনার পুত্র কোথায়?
ওকে পাশের বাসায় নিয়ে গেছে, এক্ষুণি দিয়ে যাবে।
আই সী।
পুষ্প চা বানিয়ে নিয়ে এল। মিজান চেয়ারে বসে আছে। মুখের ভঙ্গি গম্ভীর। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট কিন্তু সিগারেট টানছে না। সে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিল।
আপনি কি জন্যে আমাকে ভয় পান?
ছিঃ, কী বলেন ভাই! ভয় পাব কেন?
ভয় পান বলেই তো মিথ্যা কথাটা বললেন, ছেলে পাশের বাসায় আছে, এক্ষুণি দিয়ে যাবে যাতে আমি বুঝতে পারি যে এখানে আমাকে ভদ্র হয়ে থাকতে হবে। বেচাল কিছু করা যাবে না।
পুষ্প ক্ষীণ গলায় বলল, আমি সত্যি কথাই বলছি ভাই। নিশাত আপা এক্ষুণি বাবুকে দিয়ে যাবে।
মিজান সিগারেট ফেলে দিয়ে চায়ের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বলল, অন্ধকারে একটি সুন্দরী যেমন অসুন্দরী মেয়েও তেমনা পার্থক্যটা হচ্ছে আলোতে।
আপনি এ-সব কী বলছেন?
সত্যি কথাই বলছি। আপনার কি ধারণা, সুন্দরী মেয়ে আমি এর আগে দেখি নি? আপনাকে প্রথম দেখলাম?