কী সুন্দর গল্প।
এ-রকম সুন্দর-সুন্দর গল্প অনেক আছে। সব আমার বাবাকে নিয়ে। মাঝে মাঝে তোমাকে বলব।
এখন একটা বলুন না।
না, এখন না। তুমি বরং তোমার বাবা সম্পর্কে বল।
আমার বাবা সম্পর্কে বলার মতো কিছু নেই আপা। খুব সাধারণ মানুষ। নিজেকে। নিয়েই ব্যস্ত। আমাদের দিকে কখনো ফিরেও তাকান নি। মা মরে যাবার একুশ দিনের দিন আবার বিয়ে করেছেন। সংসার নাকি অচল হয়ে যাচ্ছে–বিয়ে না-করলেই না।
তুমি তখন কত বড়?
ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার বড় বোনের তখন বিয়ে হয়ে গেছে। একটা ছেলে আছে। আর আমাদের বোনদের বিয়ে কীভাবে হয়েছে জানেন আপা? ছেলে দেখতে এসেছে। বোনরা সবাই খুব সুন্দর তো, কাজেই দেখতে এসেই পছন্দ হয়ে গেছে। তখন বাবা বলেছেন, আলহামদুলিল্লাহ্, বিয়ে হয়ে যাক। শুভস্য শীঘ্রম। কাজি ডেকে বিয়ে।
তোমার বাবা মনে হয় খুব করিৎকৰ্মা মানুষ।
মোটই না আপা। টাকা বাঁচানোর ফন্দি। বিয়ের অনুষ্ঠান করতে হল না। আমাদের তিন বোনের বিয়ে হয়েছে কারো বিয়েতে অনুষ্ঠান হয় নি। বরপক্ষের ওরা অনুষ্ঠান করতে চেয়েছে। বাবা বলেছেন, বিয়ে তো হয়েই গেছে, আবার অনুষ্ঠান কিসের? মেয়ে উঠিয়ে নিয়ে যান।
তোমার মনে হয় বাবার উপর খুব রাগ?
আগে রাগ হত, এখন হয় না।
এখন হয় না কেন?
জানি না আপা। এখন কেমন যেন মায়া লাগে। সেও তো গরিব মানুষ আপা। কোথা থেকে টাকা খরচ করবে?
তা তো বটেই।
নিশাত অবাক হয়ে দেখল, পুষ্পের চোখে পানি এসে গেছে। মনে হচ্ছে সে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। খুবই সেনসিটিভ মেয়ে তো!
পুষ্প।
জ্বি?
চা খাবে?
না আপা।
তুমি কি খুব একা-একা থাক পুষ্প?
হ্যাঁ। ও কোথাও যাওয়া পছন্দ করে না, কাজেই কোথাও যাই না। কেউ আসেও না আমাদের এখানে শুধু ওর এক বন্ধু আসে মাঝে-মাঝে। তাকে আমার পছন্দ হয় না। শুধু আজেবাজে কথা বলে।
স্বামীর বন্ধুরা বন্ধুপত্নীদের সঙ্গে সবসময় এরকমই করে। জহিরের এক বন্ধু আছে, মাঝে-মাঝে এমন সব কথা বলে যে ইচ্ছে করে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিই।
পুষ্প হেসে ফেলল। বেশ শব্দ করে হাসি। হাসি থামিয়ে শান্ত গলায় বলল, অসময়ে উনি বাসায় আসেন, কেন জানি আমার ভালো লাগে না।
অসময়ে মানে কখন?
দুপুরের পর, আড়াইটা-তিনটার দিকে।
তুমি ওঁকে বলবে, যেন অসময়ে না আসেন।
ও আবার রাগ করবে। পল্টুর বাবার কথা বলছি। ওর চট করে রেগে যাবার অভ্যাস আছে।
তুমি তোমার অসুবিধার কথাটা বলছ, এতে ওঁর রাগ করবার তো কিছু নেই।
আমি তা বলতে পারব না আপা। তা ছাড়া মিজান সাহেব মানুষ হিসেবে খুব ভালো। সবার সঙ্গে রসিকতা করা ওঁর অভ্যাস। ওঁর মনে কোন পাপ নেই।
তাই বুঝি?
জ্বি আপা।
তবু তুমি ওঁকে বলবে যেন অসময়ে না আসেন। আমাদের দেশটা তো বিলেত আমেরিকা নয়। এ-দেশের নিজস্ব নিয়মকানুন আছে। ডিসেনসির ব্যাপার আছে। তাই না?
পুষ্প কিছু বলল না। নিশাত বলল, তোমার ওঁকে কেমন লাগে?
আমার পছন্দ হয় না।
অতিরিক্ত মেলামেশার একটা সমস্যা কি জান? কোনো-না-কোনভাবে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যে লোকটিকে শুরুতে অসহ্য বোধ হয় একসময় দেখা যায় তাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে।
কী যে বলেন আপা!
আমি ঠিকই বলি। পনের-যোল বছরের বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েকে আমি দেখেছি, বুড়ো গানের মাস্টারের প্রেমে হাবুড়ুবু খাচ্ছে। আমার নিজের কথা বলব?
বলুন।
না থাক। সব কথা এক দিনে বলতে নেই। কিছু কথা আরেক দিনের জন্যে ভোলা থাকুক।
টেলিফোন বাজতে শুরু করেছে। নিশাত টেলিফোন ধরল। ওপাশে জহিরের গলা।
নিশাত।
বল, শুনছি।
কি করছিলে?
তেমন কিছু না। তোমার কী হয়েছে বল তো! একটু পরপর…কি হয়েছে?
ভালো লাগছে না।
ভালো না-লাগলে চলে এস।
আমি ভাবছিলাম কি, বাইরে কোথাও গেলে কেমন হয়। ধর রাঙ্গামাটি বা কক্সবাজার।
হঠাৎ?
না, মানে–আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের সম্পর্কটা একটু কোল্ড যাচ্ছে।
এ-রকম ধারণা হবার কারণ কি বল তো?
না, মানে……..
যেতে চাইলে চল যাই। ঘুরে আসি। আমার তো কোনো কাজ নেই, আমি তো ঘরেই বসে থাকি।
তা হলে চলে এস না।
আচ্ছা আসছি। টেলিফোন রাখলাম, কেমন?
নিশাত রিসিভার নামিয়ে আসতে শুরু করল। মনের কিছু দরজা-জানালা এখন খুলতে শুরু করেছে। নিশাত পল্টুকে কোলে নিয়ে গায়ের ঘ্রাণ নিল। কি অদ্ভুত গন্ধ শিশুদের গায়ে!
পুষ্পদের বাড়িওয়ালা আওলাদ সাহেব
পুষ্পদের বাড়িওয়ালা আওলাদ সাহেব একজন স্কুল-টীচার। স্কুল-টীচার হয়েও তিনি শুধুমাত্র নিজের রোজগারে ঢাকায় দুটি বাড়ি করেছেন। একটি সোবহানবাগে, অন্যটি কল্যাণপুরে। কল্যাণপুরের বাড়িতে তিনি নিজে থাকেন। সোবহানবাগের বাড়িটা ভাড়া দেন। বর্তমানে চেষ্টা-তদবির করছেন লোনের জন্যে। লোন পেলেই বাড়ি ভেঙে চারতলা দালান তুলবেন। এই ব্যাপারটা তিনি অনেকক্ষণ ধরে রকিবকে বোঝাচ্ছেন। মাস্টারদের সবচেয়ে বড় ক্ৰটি হচ্ছে, তাঁরা সবাইকে তাঁদের ছাত্র মনে করেন। এবং মনে করেন কেউ তাঁদের কথা বুঝতে পারছেনা। আরো ভালোমতো বোঝনোদরকার। তিনি যে এই বাড়ি ভেঙে চারতলা দালান তুলতে চান, এটা রকিবকে বেশ কয়েক বার বললেন।
লোন পেয়ে গেলেই বাসা ছাড়তে হবে, বুঝতে পারতেছেন তো?
জ্বি, পারছি।
তখন এই অসুবিধা সেই অসুবিধা, এই রকম সতের ধরনের কথা বলতে পারবেন। না।
বলব না।
এইসব মুখের কথা সবাই বলে, কাজের সময় না। আমার বড় শ্যালক একটা বাড়ি করেছিল, বুঝলেন? একটা ভালো পার্টির কাছে বাড়ি ভাড়া দিয়েছে। পার্টি এক বছরের ভাড়া অ্যাডভান্স দিয়ে দিল। তারপর আর ভাড়া দেয় না। ভাড়া চাইতে গেলে বলে, ভাড়া দেব কেন, বাড়ি কিনে নিলাম না!