- বইয়ের নামঃ প্রিয়তমেষু
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে
কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।
নিশাত কী-হোলে চোখ রাখল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ দরজায় ধাক্কা পড়ছে। নিশাত বলল, কে? কোনো উত্তর নেই। চাপা হাসির মত শব্দ। নিশাত দরজা খুলল। আশ্চর্য কাণ্ড। এইটুকু একটা বাচ্চা। সবে দাঁড়াতে শিখেছে। তাও নিজে নিজে নয়। কিছু একটা ধরে দাঁড়াতে হয়। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে কেমন দুলছে।
খোকন, তোমার কি নাম?
খোন বিশাল একটা হাসি দিল। নিচের মাটীর একটিমাত্র দাঁত। সেই দাঁত হাসির আভায় ঝিকঝিক করছে। নিশাত উচু গলায় জহিরকে ডাকল, এই, কাণ্ড দেখে যাও।
কি কাণ্ড?
না দেখলে বুঝবে না। বিরাট এক অতিথি এসেছে।
জহির গলায় টাই বাধছিল। আয়নার সামনে থেকে নড়া উচিত নয়, তবু নড়ল। নিম্প্রণ গলায় বলল, এ কে?
পাশের বাসার। কী রকম অসাবধান মা দেখেছ? বাচ্চাকে ছেড়ে দিয়েছে। যদি সিঁড়ির দিকে যেত।
জহির আয়নার সামনে চলে গেল। টাইয়ের নটে গোলমাল হয়ে গেছে। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। সে নট ঠিক করতে করতে বলল, নিশাত, বাচ্চাটাকে ঘরে ঢুকি না।
ঢেকাব না কেন?
বাচ্চাদের একটা অদ্ভুত নিয়ম আছে, সাজানোগোছাননা ঘর দেখলেই এরা প্রাকৃতিক কর্মটি করে ফেলে। ও এক্ষুণি তা করে ফেলবে।
ফেলুক। এই খোকন, ভেতরে আসবে? টুটু টুটু।
নতুন কেনা কাৰ্পেট, খেয়াল রেখো।
নিশাত বলল, মা-টা কেমন দেখলে? একদম নেংটোবাবা করে রেখে দিয়েছে। একটা প্যান্ট পরাবে না?
আয়নায় নিশাতের ছায়া পড়েছে। জহির অবাক হয়ে দেখল, নিশাত বাচ্চাটার পেটে নাক ঘষছে। জহির হালকা গলায় বলল, আদরটা বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে যাচ্ছে না?
আদর কখননা বাড়াবাড়ি হয় না। বাড়াবাড়ি হয় ভালবাসায়।
যার বাচ্চা তাকে দিয়ে এস। দেখ কেমন গা মোচড়াচ্ছে—এটা হচ্ছে বড় কিছু করবার প্রস্তুতি।
আচ্ছা, এর হাতে একটা ক্র্যাকার দেব? গলায় বেঁধে যাবে না তো আবার?
ক্রাকারফ্যাকার দিও না। লোভে পড়ে যাবে। রোজ আসবে।
আহা আসুক না। এই খোকন, ক্র্যাকার খাবে? টুটু টুটু।
খোকন জবাব দেবার আগেই খোকনের মার ভয়-কাতর মুখ দেখা গেল। নিশাত লক্ষ করল বেচারি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে,কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। নিশাত সহজভাবে বলল, এত ছোট বাচ্চাকে একা ছাড়তে আছে? যদি সিড়ির দিকে যেত?
ও ঘুমাচ্ছিল। কখন যে জেগেছে বুঝতেও পারি নি।
বাচ্চার কি নাম? ওর নাম পল্টু।
পল্টু আবার কী রকম নাম? বড় হলে ওর বন্ধুরা ওকে বন্টু বলে খেপাবে। ওর একটা ভালো নাম রাখুন।
মেয়েটি হেসে ফেলল। নিশাত বলল, আসুন না, ভেতরে আসুন। মেয়েটি লাজুক দৃষ্টিতে জহিরের দিকে তাকাচ্ছে। নিশাত বলল, ও এক্ষুণি অফিসে চলে যাবে। আপনি বসুন, আপনার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হোক। আমরা পাশাপাশি থাকি অথচ আলাপ নেই।
ঘর খোলা রেখে এসেছি। তালা দিয়ে আসি?
বলেই মেয়েটি উত্তরের অপেক্ষা করল না। ছুটে চলে গেল।
জহির হ্যান্ডব্যাগে অফিসের ফাইল ভরতে-ভরতে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, ভদ্রমহিলা বেশ অসাবধান। ব্লাউজের বোতাম খোলা ছিল, তুমি লক্ষ করেছ?
এত কিছু থাকতে তোমার চোখ গিয়ে পড়ল ঐখানে! আয়নার ভেতর দিয়ে এত সব দেখে ফেললে?
তোমার কি ধারণা আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি?
নিশাত জবাব দিল না। তার একটু মন-খারাপ হয়েছে। জহির রাউজের এই প্রসঙ্গ না তুললেও পারত। শালীনতার একটা ব্যাপার আছে। জহিরের কি তা মনে থাকে না।
রাগ করলে নাকি নিশাত?
না। এত চট করে রাগ করলে চলে না। আজও কি তোমার ফিরতে দেরি হবে, না সকাল-সকাল ফিরবে?
রাত আটটার মধ্যে ফিরব। পজেটিভ।
পল্টু সাহেব তার কাজটি এখন সারছেন। কার্পেটের উপর তীর বেগে ঝর্নার ধারা পড়ছে। পল্টুর মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। নিশাত অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকাল জহিরের দিকে। জহির কিছু বলল না। ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেল। তার আজকের বিদায় অন্য দিনের মত হল না। অন্য দিন নিশাত তাকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। সিড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে দু-একটা টুকটাক কথা হয়। আশেপাশে কেউ না-থাকলে জহির অতি দ্রুত তার ঠোঁট এগিয়ে আনে। সেই সুযোগ সে খুব বেশি পায় না।
পর মা ফিরে এসেছে। এর মধ্যেই সে বেশভুষার কিছু পরিবর্তন করেছে। প্রথম যে-জিনিসটা নিশাতের চোখে পড়ল, তা হচ্ছে ব্লাউজের বোতাম লাগান। চুল খোঁপা করা। পরনে অন্য একটা শাড়ি।
আপা আসব?
আসুন আসুন।
উনি অফিসে চলে গেছেন, তাই না?
হ্যাঁ।
আপনি তো আজ ওঁকে এগিয়ে দিলেন না? রোজ দেন।
নিশাত একটু যেন হকচকিয়ে গেল। অবশ্যি তার বিস্ময়ের ভাব তেমন প্রকাশ পেল না। এই মেয়েটি যদি অফিসে এগিয়ে দেবার ব্যাপারটা লক্ষ করে তা হলে আরো কিছু হয়তো লক্ষ করেছে। নিশাত সহজ গলায় বলল, আপনি চা খাবেন? চাকরি আপনার জন্যে?
জ্বি আচ্ছা। আর আপা, আমাকে আপনি-আপনি করে বলবেন না। আমার বয়স কিন্তু খুব কম।
তাই নাকি?
জ্বি। ম্যাট্রিক পরীক্ষার মাঝখানে আমার বিয়ে হল। অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে বাসায় এসে শুনি আমার বিয়ে। কয়েক জন লোক ডেকে এনে বিয়ে। সেই রাতেই শ্বশুরবাড়ি চলে গেলাম।
বাকি পরীক্ষাগুলো নিশ্চয়ই দাও নি?
জ্বি-না। আমার শ্বশুরসাহেব বললেন, মেয়েদের আসল পরীক্ষা হল সংসার। ঐ পরীক্ষায় পাস করতে পারলে সব পাস।