সেসময় আমাদের এখানেও অনেকগুলি খবর তৈরি হল, যেগুলি তাকে জানান গেল না। যেমন অনুর বিয়ে হয়ে গেল নারায়ণগঞ্জের এক উকিলের সঙ্গে। খুবই ভালো বিয়ে। শহরের উপর তাদের বাড়িটাড়ি আছে। ছেলের চেহারাও সুন্দর। অনুর (যে খানিকটা তোতলিয়ে কথা বলে) এতটা ভালো বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না। আমরা খুবই খুশি। পরে অবশ্য জানা গেল, উকিল সাহেব আগে এক বার বিয়ে করেছিলেন এবং সেই বিয়ের একটি ছেলেও আছে। দ্বিতীয় বার বিয়ের সময় স্ত্রীর খবর চেপে গিয়েছেন। ভদ্রলোক কেন এটা করলেন কে জানে?
বিয়ের এই খবর মেজো ভাইকে জানান গেল না। মা মারা যাবার খবরও জানান গেল না। তিনি মারা গেলেন হঠাৎ করেই। রাতের বেলা জেগে উঠে বললেন, তাঁর বুক জ্বালা করছে। বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, ও কিছু না, খেসারির ডাল বেশি খেয়েছ, তাই অম্বল হয়েছে। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে শুয়ে থাক। মা তাই করলেন। ঘন্টা খানিক পর উঠে বসে বললেন, বুক জ্বলে যাচ্ছে। বাবা বললেন, এক গ্রাস লেবুর শরবত করে খাও। খেয়ে শুয়ে থাক।
বাবার কথা মার কাছে নবীর ওহীর মতো। ঘরে লেবু ছিল না। চিনির শরবত বনিয়ে খেলেন এবং ছটফট করতে লাগলেন। বাবা বললেন, চেঁচামেচি করলে কি আর ব্যথা কমবে? শুয়ে থাক। ভোরবেলা ডাক্তারকে খবর দেব।
শেষ রাতে আমরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তাররা বললেন, ফুড পয়জনিং আলুপটলের তরকারি এবং খেসারির ডাল খেয়ে আমাদের কারো কিছু হল না, তাঁর ফুডপয়জনিং হয়ে গেল? কোন মানে হয়।
বৃষ্টি থেমে গেছে। মনসুরের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না। ওরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? আমি সাবধানে উঠে বসলাম, তলপেটের ব্যথাটা টের পাচ্ছি। লক্ষণ ভাল নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ব্যথা আমাকে কাবু করে ফেলবে। মনসুরকে হয়তো ডাকতে হবে। আমি প্রাণপণে ব্যথাটা সামাল দিতে চেষ্টা করলাম। কিছু কিছু জিনিসকে কিছুতেই সামাল দেওয়া যাবে না। একেও যাবে না। এর নিজস্ব একটি জীবন আছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে নাড়িজুড়ি ফেটে বেরিয়ে আসবে। ডাকব না ওদের, কিছুতেই ডাকব না। বমি করতে ইচ্ছা হচ্ছে। হারিকেনের আলো ক্ৰমেই বাড়ছে। আমি মৃদু স্বরে মাকে ডাকলাম, মা তুমি কোথায় আছ? এস, ব্যথা কমিয়ে দাও।
পাশের ঘর থেকে শব্দ হচ্ছে। মনসুর উঠে আসছে। রীতার গলা পাওয়া যাচ্ছে। কী যেন বলছে সে। আমি ক্ষীণ স্বরে ডাকলাম, মনসুর। কেন ডাকলাম? সে কিছুই করতে পারবে না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া এখন কেউ কিছু করতে পারবে না। তবু মনে হয় কেউ আসুক। পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকুক। মনসুরের গলা পাওয়া যাচ্ছে, এই ফরিদ, কী হয়েছে? আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, মরে যাচ্ছি। আমি মরে যাচ্ছি।
মনসুর আমার হাত ধরে রেখেছে। রীনাবসে আছে আমার ডান পাশে। সেবড়ো ভয় পেয়েছে। রীনা ফিসফিস করে বলল, কোথায়, কোন জায়গায় ব্যথা? ঘরের আলো কমে আসছে। রীতার মুখ অসম্ভব বড় মনে হচ্ছে। রীনা আবার বলল, কোথায় ব্যথা? কোথায়?
ঠিক অন্য সব দিনের মতোই আমার ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে দেখলাম মনসুর এবং রীনা বসে আছে চেয়ারে। মশারি তোলা। মাথার কাছে একটা ছোট টেবিল ফ্যান। পাখা ঘুরছে।
কি রে, কেমন লাগছে?
ভালো।
কিছুক্ষণ পরই তুই ঘুমিয়ে পড়লি। রীনা বলেছিল, তুই অজ্ঞান হয়ে গেছিল। মাথায় পানি ঢাললাম।
আমি ফ্যাকাশেভাবে হাসতে চেষ্টা করলাম। রীনা বলল, ব্যথাটা আপনার কতক্ষণ থাকে?
বেশিক্ষণ না। কমে গেলেই ঘুম এসে যায়। লম্বা ঘুম দিয়ে ফ্রেশ হয়ে যাই।
আপনি কিছু খাবেন? চা আর টোস্ট এনে দিই? নাকি এক পিস কেক খাবেন?
চা খাব। শুধু চা।
রীনা উঠে চলে গেল। মনসুর বলল, ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলি। হাত-মুখ ধুবি? পানি এনে দিই?
এনে দিতে হবে না। নিজেই বাথরুমে যাব।
চুপচাপ শুয়ে থাক, নড়াচড়া করি না।
এখন আর কিছু হবে না। মনসুর বলল, আজ আমি আর অফিসে যাব না। ঠিক করেছি, ঘরেই থাকব। সে হাই তুলল। তার চোখ লাল। বেচারা সারা রাত কষ্ট করল।
মনসুর।
বল।
চা খেয়ে আমি বেরুব।
কোথায়?
মীরপুর পাঁচ নম্বর সেকশন। বাবাকে দেখে আসি।
আজ শুয়ে থাক, নড়াচড়া করিস না।
আজ না গেলে আর সময় পাব না।
চল আমিও যাই তোর সঙ্গে।
না।
আমি তোর সঙ্গে গেলে অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে। ঐ বাসায় কাউকে নিয়ে যাই না।
ভেবেছিলাম আমাকে যেতে দিতে রীনা আপত্তি করবে। সে করল না। মেয়েটি ভয় পেয়েছে। কাল রাতের মতো কোনো দৃশ্য সে সম্ভবত দ্বিতীয় বার দেখতে চায় না। না চাওয়াই ভালো।
সারা রাত বৃষ্টি হবার জন্যেই বোধহয় রাস্তাঘাট ঝকঝক করছে। গাছের পাতা অন্য দিনের চেয়েও বেশি সবুজ। চারদিক চকলেটের রাতার মতো ঝিলমিল করছে। মন ভালো হয়ে যাবার মতো একটা সকাল। অপূর্ব। এরকম একটি সকালে পুরনো কথা মনে পড়ে না, শুধু বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।
ভেবেছিলাম বাসে করে যাব। এই সময় মীরপুরের দিকের বাস ফাঁকা যায়। কিন্তু মনসুরের জন্যে পারা গেল না। সে আমাকে কিছুতেই বাসে উঠতে দেবে না। বাসে উঠলেই নাকি আমার তলপেটের নাড়িতুড়ি ঝাঁকুনিতে ফেটে চৌচির হবে। সে বাইশ টাকায় এক বুড়ো রিকশাওয়ালাকে রাজি করিয়ে ফেলল। গলার স্বর নামিয়ে অন্তরঙ্গ স্বরে বলল, বুড়ো মিয়া, খুব আস্তে আস্তে চালাবেন। রুগী মানুষ। দু দিন পর অপারেশন।
রিকশাওয়ালাকে এত কথা বলার কোনোই দরকার নেই। রিকশাওয়ালা চলবে তার নিজের মতো।