রীনা চা নিয়ে এসে বসল আমাদের সঙ্গে। বেশ লাগছে মেয়েটিকে। এমনিতে তাকে এতটা ভালো লাগে না। আমি লক্ষ করেছি অসুন্দর মেয়েদেরও মাঝে মাঝে অপরূপ রূপবতী মনে হয়–যেমন গায়ে হলুদের দিন। শুধু এই দিনটিতেই কোনো এক বিচিত্র কারণে তারা দেবীমূর্তির মতো হয়ে যায়।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, আমরা চা খাচ্ছি নিঃশব্দে। রীনা খুব কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমি বললাম, আপনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।
বিয়ের শাড়িতে সবাইকে সুন্দর লাগে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। মনসুর বসে আছে গম্ভীর হয়ে। সে কি কেকের মীনাকে রীনা করেছে? আমি বললাম, কটা বাজে রে?
যতটা বাজুক, তুই বসে থাক চুপচাপ। রাতে তোক যেতে দেব না।
বলিস কি!
রীনা নিচু স্বরে বলল, হাসপাতালে ভর্তি হবার আগের কটি দিন আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
মনসুর বলল, আমি কাল সকালে তোর জিনিসপত্র সব নিয়ে আসব।
নতুন জায়গায় আমার ঘুম হয় না।
না হলে না হবে। ফালতু কথা।
রীনা বলল, আপনি থাকবেন বলে আপনার বন্ধু চাদর-বালিশ এই সব কিনে এনেছে। না থাকলে ওর কষ্ট হবে। কয়েক দিনের ব্যাপার তো, থেকে যান।
আমি কঠিন স্বরে বললাম, মনসুর, আমি জানি আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে আসব না। কাজেই যে কটা দিন আমি আছি, আমাকে নিজের মতো থাকতে দে। এই নিয়ে ঝামেলা করি না।
মনসুর গম্ভীর স্বরে বলল, এখানে তোর কোনোকষ্ট হবে না।
জানি কষ্ট হবে না, এখানে অনেক সুখে থাকব। তবু তুই আমাকে আমার মতো থাকতে দে।
রীনা বলল, আজকের রাতটা অন্তত থাকুন। বেচারা আপনার জন্যে নতুন চাদর-বালিশ কিনেছে।
আমি কিছু বললাম না। রীনা নরম স্বরে বলল, ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ফেরত যাবেন কী ভাবে? রাতও অনেক হয়েছে। আজকের রাতটা থাকুন। এক রাতে কী হবে?
ঠিক আছে, থাকব।
মনসুর মুখ কালো করে বলল, ইচ্ছা না হলে থাকতে হবে না।
কিছু কিছু মানুষের বয়স বাড়ে না। তারা মনসুরের মতো সারা জীবন শিশু থেকে যায়। আজ সারা রাত সে হয়তো কথাই বলবে না। অথচ আমাকে এখানে জড়ানর তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আজকের এই ঝড়জলের রাত হচ্ছে তাদের দু জনেরা আজ তাদের একটা চমৎকার উৎসবের রাত। আমার এখানে স্থান কোথায়?
অপরিচিত জায়গায় অপরিচিত পরিবেশে আমি ঘুমুতে পারি না। তার উপর আজ বিকেলেই বড় একটা ঘুম দিয়েছি। আমি মশারির ভেতর গা এলিয়ে শুয়ে রইলাম। ঘুম আসবে না জানি, ঘুমাবার চেষ্টা চালিয়ে যাবার কোনো অর্থ হয় না।
মেঝেতে হারিকেন ডিম করা। কেমন গ্রাম-গ্রাম লাগছে। আলো না থাকলেই বোধহয় ভালো ছিল। কিন্তু মনসুর শুধু হারিকেন নয়, একটা টৰ্চলাইটও বালিশের নিচে রেখে গেছে। যতের চূড়ান্ত করতে চেষ্টা করছে দুজনেই।
টেবিলের উপর ঝকঝকে পানির জগ, গ্লাস। রাতে খিদে পেলে খাওয়ার জন্যে হরলিকসের টিনে কিছু বিসকিট। গোবার আগে রীনা এল মশারি গুজে দিতে। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, ছি ছি, আমি বুঝি মশারি খুঁজতে জানি না? লাভ হল না। মনসুর কমপক্ষে দশ বার বলল, অসুবিধা হলেই ডাকবি। আমার পাতলা ঘুম, এক বার ডাকলেই হবে।
ঘড়িতে রাত প্ৰায় একটা। ফিসফিস করে ওরা কথা বলছে। এক বৎসর পরও এত কথা থাকে নাকি কারো? স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার কথাবার্তা শুনতে বড়ো অস্বস্তি লাগে। ওদের কথাবার্তা অবশ্যি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, তবু বড়ো অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে একটা কিছু অপরাধ যেন করে ফেলেছি।
আমার বড়োভাইয়ের বিয়ের পরও এমন অবস্থা। তাদের লাগোয়া ঘরটিতে আমি থাকি। গভীর রাত পর্যন্ত দু জন কথা বলে। শুনতে ইচ্ছা করে না, তবু শুনতে হয়। যত অর্থহীন কথাবার্তা অর্থহীন রসিকতা। সকালবেলা ঘুম ভেঙে ভাবীকে দেখলেই বড়ো লজ্জা লাগে। চোখ তুলে তাকাতে পারি না, এমন অবস্থা। ভাবীর আচার-আচরণ কিন্তু খুব স্বাভাবিক। সবার সঙ্গে হাসছে, গল্প করছে। নতুন নতুন রান্নাবান্না করছে। ভাবীকে দিয়ে আমাদের সংসারের শ্ৰী ফিরে গেল। বাবু পর্যন্ত নিচু স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন। মাঝে-মধ্যে হাসতেও লাগলেন।
তারপর এক দিন বাসায় এসে শুনি বড়োভাই আলাদা বাসা করেছেন। তাঁর শশুর নাকি অল্প ভাড়ায় কী একটা বাসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শুধু বাসাই নয়, তিনি নাকি তাকে একটা সাইড বিজনেসের কথাও বলেছেন। টাকা তিনি দেবেন। বড়োভাই অতিরিক্ত রকমের উৎসাহের সঙ্গে বললেন, এই সংসারের খরচ আমি আগে যেমন দিতাম এখনো দেব। চিন্তার কিছু নেই। মা বিশেষ ভরসা পেলেন না। মায়েরা অনেক জিনিস আগে আগে বুঝতে পারে।
আসলে আমাদের কারোরই মা-বাবার প্রতি তেমন টান ছিল না। মেজো ভাই জার্মানি গিয়ে চুপচাপ হয়ে গেল। দু মাস তিন মাস পরপর চিঠি আসে। একটি চিঠিতে জানলাম ল্যাঙ্গুয়েজ পরীক্ষায় পাস করতে পারে নি। সম্ভবত তাকে দেশে ফিরে আসতে হবে। বাবা প্রায় পাগলা কুকুরের মতো হয়ে পড়লেন। সে অবশ্যি দেশে ফিরল না। মাস ছয়েক পর চিঠি এল, সুইডেনে চলে এসেছে। সে চিঠিতে কোনো ঠিকানা নেই, লেখা আছে এখনো কোন স্থায়ী ঠিকানা হয় নাই। হওয়া মাত্রই জানাইব। এক বৎসরেও তার কোন স্থায়ী ঠিকানা হল না। আমরা তাকে কিছু লিখতে পারি না। কোন খবর দিতে পারি না। কী অবস্থা। এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল, কাগজপত্র না থাকায় তাকে নাকি সুইডেনের এক জেলখানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। খবর কতটুকু সত্যি জানার উপায় নেই।